নওগাঁ জেলার নামকরণ ইতিহাস:
নওগাঁ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (নতুন) ও ‘গাঁ’ (গ্রাম) শব্দ থেকে। শব্দ দুটি ফার্সি। নওগাঁ শব্দের অর্থ হলো নতুন গ্রাম। প্রচলিত মতে জানা যায়, সন্নিহিত নয়টি চক বা জনবসতির সমন্বয়ে গঠিত ‘নয় গাঁ’ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে নওগাঁ নাম ধারণ করেছে। গ্রামগুলো হলো- ১. খাস-নওগাঁ, ২. হাট-নওগাঁ, ৩. পার-নওগাঁ, ৪. আরজী-নওগাঁ, ৫. চকইলাম, ৬. চকদেব, ৭. চকএনায়েত, ৮. চকমুক্তার ও ৯. গঞ্জ। নওগাঁ নামের বানান এবং উচ্চারণে বেশ বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। ১৩২৫ বঙ্গাব্দে মুন্সী শুকুরুল্লাহ তরফদার প্রণীত একটি বাংলা পুস্তকে নওগাঁকে নওগাঁও বলা হয়েছে। শহর সন্নিহিত গ্রামবাসীর অনেকে একে লগাঁও বলেন।
নওগাঁ জেলার উপজেলার নাম: নওগাঁ সদর, নিয়ামতপুর, আত্রাই, বদলগাছি, মহাদেবপুর, পত্নীতলা, ধামইরহাট, সাপাহার, পোরশা, রাণীনগর, মান্দা।
নিয়ামতপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
আরবী নিয়ামত শব্দ হতে নিয়ামতপুর উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। নিয়ামত শব্দের অর্থ (বিশেষ্য) ১ তোহফা; ধন; সম্পদ, সৌভাগ্য, অনুগ্রহ। নিয়ামতপুরের পূর্ব নাম ছিল হোকমাডাংগা । ইতিহাস হতে জানা যায়, গৌড় বাংলার রাজধানী থাকাকালীন সময়ে সেখানে মহামারী দেখা দিলে সেই এলাকা হতে বহু লোক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। সেই সময় একটি পরিবার বর্তমানে নিয়ামতপুর উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামে এসে বসবাস আরম্ভ করে । কথিত আছে যে,জনৈক ধর্মপ্রাণ দরবেশ ব্যক্তি এই হোকমাডাংগায় আগমণ করলে নিয়ামতপুরের বর্তমান চৌধুরী এবং দেওয়ান বংশের আদিপুরুষগণ নজর নিয়ামত ও বিভিন খাদ্য সামগ্রী তার সন্মার্থে তৌহফা হিসেবে পেশ করেন। ভোগের রসনা সামগ্রী দেখে তিনি অত্যন্ত খুশী হন এবং বলেন যে,যেখানে আল্লাহপাক এত নিয়ামত দান করেছেন সেই স্থানের নাম সুন্দর হওয়া দরকার। তাই তিনি হোকমাডাংগার পরিবর্তে স্থানটির নাম করণ করেন নিয়ামতপুর ।
আত্রাই উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
আত্রাই নদীর নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে আত্রাই। হিন্দু পূরাণে আত্রাই নামের উল্লেখ আছে ঠিক এভাবে “আত্রোয়ী ভঅরথী গঙ্গা যমুনা স্বরস্বতী/সরযু গঙ্গী পুণ্যাণে ও গঙ্গা চ কৌমিনী”।
বদলগাছি উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
কথিত আছে যে, মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলনের পূর্বে দ্রব্য বিনিময় (বা বার্টার সিস্টেম) প্রয়োজনে বদলগাছী নামক স্থানটিকে ব্যবহার করত। দ্রব্য বদলাবদলীর উপর্যুক্ত স্থান হিসেবে এবং যার ফলশ্রুতিতে স্থানের নাম হয়েছে বদলগাছী।
মহাদেবপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
অনুমান করা হয় যে, ১৭৫৭ সালে পলাশীতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজয়ের পর এ উপমহাদেশে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব কমতে থাকে যার প্রভাব এখানেও এসে পড়ে। অপর দিকে ইংরেজদের কোপানলে পতিত মুসলমানদের রাজত্ব শেষে ইংরেজদের সাবেক স্নেহভাজন ও নব্য গজিয়ে উঠা ধর্মীয় প্রভাবশালী হিন্দু সম্প্রদায় তাদের অবস্থান দৃঢ় করে নেয় এবং সমাজের সকল স্তরে প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে। ক্ষমতা ও সমাজ পরিবর্তনের এ ত্রুান্তিলগ্নে সর্বক্ষেত্রে হিন্দু প্রভাবের প্রেক্ষাপটে দেব-দেবীর নামানুসারে বিভিন্ন গ্রাম বা স্থানের নামকরণ হতে থাকে । এখানে এভাবে লক্ষ্মীপুর, ভীমপুর, রামচন্দ্রপুর, সরস্বতীপুর, দেবীপুর ইত্যাদি গ্রামগুলোর উৎপত্তি হয়। এভাবে দেবতা শিব মহাদেবের নাম অনুসারে মহাদেবপুর নামকরণ হয়েছে বলে অনুমিত হয় ।
পত্নীতলা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
পাঠান রাজত্বকালে বরেন্দ্র এলাকার অনেক পরগণা পাঠান জমিদারদের অধীন ছিল। পাঠান নৃপতি বা রাজ কর্মচারীরা বর্তমান পত্নীতলা বাজারে অবস্থান করে জমি পত্তন দেওয়ার কাজ সমাধা করতেন। পত্নীতলা নামটি এসেছে সেই পত্তন শব্দ থেকে পত্তনী এবং ক্রমে পত্তনীতোলা বা পাঠানতোলা নামকরণ হয়, সেখান থেকে ক্রমে আসে ।
ঐতিহাসিক বিবরণ ১: পত্তনীতোলা,পাঠানতোলা কিংবা পাটনীতোলা ক্রমশ রূপান্তরিত হয়ে পত্নীতলা নাম করনের পিছনে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে পাঠান রাজত্বকালে বরেন্দ্র এলাকার অনেক পরগণা পাঠান জমিদারদের অধীন ছিল। পাঠান নৃপত্তি বা রাজ কর্মচারীগণ বর্তমান পত্নীতলা বাজারে অবস্থান করে জমি পত্তন দেওয়ার কাজ সমাধা করতেন। পত্তন শব্দ থেকে পত্তনী এবং ক্রমে পত্তনীতোলা বা পাঠানতোলা নামে এতদঞ্চলে অভিহিত হতে থাকে।
ঐতিহাসিক বিবরণ ২: কথিত আছে যে,তাহির রাজবংশে জনৈক পূর্ব পুরুষ শ্যযুক্ত কংশ নারায়ন তাহিরপুরের এক মুসলমান জমিদারের নিকট থেকে পরগনা কেড়ে নিয়ে একটি কালি মন্দির পত্তন করে। অপরাপর হিন্দু জমিদার ও এ মন্দিরের নামে জমি পত্তন দিতেন ক্রমে জায়গাটি পত্তনীতোলা নামে পরিচিত হয়।
ঐতিহাসিক বিবরণ ৩: এছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে যে,পাঠান শাসন আমলে আত্রাই নদীতে খেয়া পারাপারের জন্য সুদুর বিহারের দার ভাংগা থেকে কিছু সংখ্যাক পাটনী সম্প্রদায়ের লোক এসে বসবাসের জন্য একটি টোল বা মহলা স্থাপন করে এবং এলাকার নাম পাটনীটোলা বলে অভিহিত হয়। উলেখ্য যে,পাটনী সম্প্রদায়ের কিছু লোক এখন ও আত্রাই নদীতে খেয়া পারাপারের কাজে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।
পত্নী শব্দটি স্ত্রী শব্দের একটি প্রতিশব্দ, যে কারণে এই উপজেলাটি নিয়েও অনেকে হাস্যরস করে থাকেন। এজন্য এ নাম পরিবর্তনের পক্ষে বিপক্ষে মতামত জোরালো হচ্ছে।
আরো জানুন: বাংলাদেশের ৬৪ জেলা উপজেলা সহ বিভিন্ন স্থানের নামের ইতিহাস
ধামইরহাট উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
রাজশাহী জেলার ইতিহাস রচয়িতা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাজী মোহাম্মদ মিছের মহোদয়ের বর্ণনা মতে- ‘ধামা’ শব্দ থেকে ধামইরহাট শব্দের উৎপত্তি। আর এর পিছনের ঐতিহাসিক সূত্র হল, ১৮৫৫ সালের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে সাওতাল উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে রাজমহল ত্যাগ করে দুরবর্তী দুর্গম, পাহাড়, বন, জঙ্গলে পালিয়ে আত্নরক্ষা করে। এদেরই একটি শাখা বর্তমান ধামইরহাট উপজেলা পরিষদের দক্ষিণাংশে জঙ্গলে বসবাস শুরু করে। কালক্রমে প্রাণ ভয়মুক্ত হয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে সহজ লভ্য বাঁশ ও বেঁত দিয়ে মানুষের দৈনন্দিন গৃহস্থালী কাজের অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তত কাজে মনোযোগ দেয়। এসব সামগ্রীর পসরা নিয়ে সপ্তাহের রবিবার দিন মাহালীরা বর্তমান হাট খোলায় বিক্রি করতে বসতো। পণ্যগুলির মধ্যে ধামাই ছিল প্রধান। কেননা এ সময় লেন-দেনের জন্য বাটখারা বা দাঁড়িপাল্লা পরিবর্তে ধামার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
সাপাহার উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
ঐতিহাসিক বিবরণ ১ : এলাকার একাধিক প্রবীন ব্যক্তিদের নিকট থেকে জানা গেছে বৃটিশ শাসনামলে এই এলাকা হিন্দু অধ্যসুতি এলাকা ছিল তৎকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শম্পা রানী নামে এক সুন্দরী বাঈঝি তার নাচ গানে এলাকাকে মাতিয়ে রেখেছিল। অনাকাঙ্খিত ভাবে সে সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের এক সুফি সাধক সেই শম্পারাণীর প্রেমে পড়ে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তখন হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার এই প্রেম কিছুতেই মেনে নিতে না পারায় অবশেষে বাঈঝি শম্পাকে প্রেমের দায়ে সমাজচ্যুত হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হয়। বাঈঝি শম্পার মৃত্যুতে প্রেমিক সুফি সাধক পাগল হয়ে যায় এবং বাঈঝি শম্পার নাম কাগজে লিখে হার বানিয়ে গলায় পরিধান করে ঘুরে বেড়ায়। পরবর্তীতে পাগল সুফি সাধকের ও মৃত্যু হলে উপজেলা সদর ঈদগাহ সংলগ্ন এলাকায় তাকে কবরস্থ করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের সুফি সাধক ও হিন্দু সম্প্রদায়ের শম্পা রাণীর প্রেমর ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতে এলাকার নাম হয় শম্পাহার। কালের আবর্তনে সেই শম্পাহার থেকেই বর্তমান সাপাহার।
ঐতিহাসিক বিবরণ ২ : এ ছাড়া অনেকের মতে সাপাহার এর নাম করণের ইতিহাস ভিন্ন। কাহারো মতে প্রাচীন কালে এখানে এক উপজাতী বাস করত আর তাদের খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য পেত বরেন্দ্র এই অঞ্চলের গুই সাপ। তারা এই গুই সাপগুলিকে নির্বিচারে ধরে খেত এবং তার চামড়া দিয়ে সুন্দর সুন্দর মানিব্যাগ ও তাদের বাচ্চাদের গলার হার তৈরী করত মূলত সেই থেকেই এই স্থানের নামকরন হয়েছে সাপাহার।
পোরশা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ বছর আগে কিছু পারস্য জনগোষ্ঠী জীবিকার তাগিদে অত্র এলাকায় আছে এবং বর্তমান উপজেলা সদর থেকে ০৫ কিঃমিঃ দূরে পোরশা নামক গ্রামে জনবসতি গড়ে তোলে। পোরশা গ্রামের নাম অনুসারে পরবর্তীতে অত্র থানা/উপজেলার নামকরণ হয় পোরশা।
রাণীনগর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
নামকরণের সুত্র ১ : ১১শ/১২শ শতাব্দীর পাল বংশের পরাক্রমশালী জমিদার খট্টেশ্বর রাজার প্রভাবশালিনী রানীর সম্মানার্থেই মৌজার নাম রাণীনগর আর রাজার নামে নামকরণ হয় খট্টেশ্বর পরগনা। খট্টেশ্বর-রাণীনগরে আবস্থান ছিল খট্টেশ্বর রাজার বাড়ি।
নামকরণের সুত্র ২ : রাণীনগর নামকরণের অপর একটি প্রবচন আছে যে, নাটোরের রানী ভবানী পিতৃগৃহে গমনের সময়ে বর্তমান রাণীনগর হাটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন এই থেকে স্থানের হয় রাণীনগর।
মান্দা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
কিংবদন্তী রয়েছে, হিন্দু প্রধান বর্তমানের কসবা মান্দায় (নামান্তরে ঠাকুরমান্দা) যে রঘুনাথ মন্দির আছে, তার সেবাইত ছিলেন জনৈক “মানদাদেবী” এবং পুজারী ছিলেন জনৈক রঘুনাথ । এখানে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটে । অন্ধ ব্যক্তি চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতেন । এই মানদা দেবীর কৃপা লাভের আশায় সমবেত ভক্ত গণের ভক্তি ভাবেদেয়া নামে এলাকার নাম হয় (মান্দা বা মান্দা)।
তথ্যসুত্র:
- জাতীয় তথ্য বাতায়ন,
- বিবিসি বাংলা
- বাংলা ট্রিবিউন,
- উত্তরাধিকার 71 নিউজ।
- বাংলাদেশের খবর।
- বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলা নামকরণ ঐতিহ্য//মোহাম্মদ নুরুজ্জামান