ষাট গম্বুজ মসজিদের নামকরণ ও ঐতিহাসিক বিবরণ

ষাট গম্বুজ মসজিদ নামকরণঃ 

ফার্সী ভাষায় স্তম্ভ বা খুঁটি বা পিলার কে গম্বুজ বলে।  কেউ কেউ অনুমান করেন যে মসজিদের অভ্যন্তরে যে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে, তা থেকেই ৬০ গম্বুজ নামের উৎপত্তি। আবার কেউ বলেন যে, মসজিদের ওপর ‘সাত’ সারি গম্বুজ থাকার দরুন ‘সাত’ থেকে ষাটগম্বুজ নামকরণ হয়েছে। আবার অনেকে বলেন যে, সমতল কোন ছাদ নেই গম্বুজ বিশিষ্ট আর্চের ছাদ আছে। তাই ছাদ থেকে রূপান্তর হয়ে ‘ষাট’ হয়েছে। আর এ কারণেই এই মসজিদকে ষাট গম্বুজ মসজিদ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়।

বিশেষত্বঃ প্রত্নস্থানটি ১৯৮৫ সালে ঐতিহ্য কেন্দ্র ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব হিসেবে ঘোষিত হয় । এ মসজিদটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করেছে।

মসজিদের বর্ণনাঃ

মসজিদের বাইরে এক বিরাট এলাকা জুড়ে একটি বেষ্টক প্রাচীন দেওয়াল ছিল এবং পূর্বদিকে ছিল মসজিদের প্রধান প্রবেশ তোরণ। তোরণের দু’পাশে ছিল দু’টি কক্ষ। কক্ষ দু’টিতে বেষ্টক প্রাচীন প্রাচীর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু প্রবেশ তোরণটি আছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রবেশ তোরণটি প্রায় ১৫/১৬ বছর পূর্বে সংস্কার করেছে। পাহাড়পুর ও বাগেরহাটের সংস্কার সংরক্ষণ প্রকল্প কর্তৃক প্রাচীন বেষ্টক দেওয়ালটি ১৯৯৫-৯৬ সালে সংস্কার করা হয়। কিন্তু প্রধান প্রবেশ তোরণের দু’পাশের দু’টি কক্ষ এখনও পর্যন্ত সংস্কার করে দেয়া হয়নি বলে জানা য়ায়। ষাটগম্বুজ মসজিদ একাধারে মসজিদ, ঈদগাহ, দরবারগৃহ, মাদ্রাসা, হোজরখানা, খানকা শরীফ মোসাফীর খানা, লঙ্গর খানা, সরাইখানা, সৈনিকদের দূর্গ ও বিচারালয় প্রভৃতি রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। স্থাপত্য কৌশলে ও লালপোড়া মাটির ওপর লতা পাতার অলংকরণে মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পের এই মসজিদ এক বিশাল স্থান অধিকার করে আছে। মধ্যযুগীয় খলিফাতাবাদ নামীয় রাজ্যের রাজধানী শহর রগাই রাহাতের সদরদফ্তর ছিল এবং এ ষাটগম্বুজ মসজিদে বসেই উলুঘ খানজাহান আলী (রঃ) তাঁর রাজ্য পরিচালনা করতেন। এখান হতেই তিনি রাজ্য পরিচালনার জন্য আঞ্চলিক গভর্নরদের নির্দেশ ও ফরমান জারি করতেন। পশ্চিম দেয়ালে কেন্দ্রীয় মেহরাবের উত্তর দিকে যে দরজাটি আছে, তা এ ধারণার পেছনে সমর্থন যোগায়। আঞ্চলিক গভর্নরগণ তাঁদের অবিসংবাদিত নেতার দর্শন লাভের জন্য প্রতিনিয়ত এই ষাট গম্বুজ মসজিদে আসতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ-উপদেশ ও হিতোপদেশসহ যার যার গন্তব্যে ফিরে যেতেন যথাসময়ে। এই নিরিক্ষে ষাটগম্বুজ মসজিদ ছিল মধ্যযুগীয় খলিতাবাদ রাজ্যের সচিবালয়। সেখানকার ফরমানে পরিচালিত হত গোটা রাজ্যটি। উল্লেখ্য যে, উলুঘ খানজাহান (রঃ) মাজার এবং তার নির্মিত অন্যান্য ইমারতের গঠন প্রণালী ও স্থাপত্য কৌশল দেখে পন্ডিতেরা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, এই বিরাট কীর্তি খানজাহান আলী (রা) ছাড়া আর কেউ নির্মাণ করেননি। পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মেহরাব আছে। মেহরাব আরবী শব্দ অর্থ রাখার স্থান। অর্থ্যাৎ হযরত উলুঘ খানজাহান আলী (রঃ) এ সৈন্য, মুরীদ, সাথী ও ভক্তগণ নামাজ, ওয়াজ ও বিচারের সময় অস্ত্র ও ছামান মেহরাবে রেখে দিতেন। যদি কোন বিপদ সংকেত পেত তাহলে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র হাতে নিয়ে সৈন্যগণ মেহরাব বরাবরে পূর্বদিকে ১০টি দরজা দিয়ে যেতে পারতো। এ কারণে ১০টি মেহরাব বরাবর পূর্বদিকে ১০টি দরজা রয়েছে। ১১টি মেহরাব থাকার কথা। কেন্দ্রীয় মেহরাবের উত্তরে সেখানে একটি মেহরাব থাকার কথা, সেখানে ১টি ছোট দরজা আছে। এটি ভিআইপি দরজা। কারণ হযরত উলুঘ খানজাহান আলী (রা) একজন রাজা, ধর্মীয় মহান নেতা, মহা সাধক, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান আর্কিটেকচার ও সেনাপতি ছিলেন। তিনি উক্ত দরজা দিয়ে যাতায়াত করতেন। পরবর্তীতে তার খলিফা অথবা ইমাম যাতায়াত করতেন। বর্তমানে উক্ত দরজা বন্ধ রাখা হয় শুধু ঈদ ও বার্ষক মাহফিলের সময় খোলা রাখা হয়। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি পাথরের তৈরি এবং আকারে বেশ বড়। এতে পাথরের উপর সুন্দর অলংকরণ ছিল। সেসব কারুকার্যের কিছু নিদর্শন এখনও টিকে আছে যেমন-পদ্মফুল, লতাপাতা ইত্যাদি। বাকি ৯টি মেহরাবের সেসব কারুকার্যের নিদর্শন এখনও টিকে আছে। ১টি মেহরাব ব্যতিত ৮টি মেহরাবের অর্ধেকের মত ২০০১ সালে পাহাড়পুর ও বাগেরহাট প্রকল্প, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর আওতায় সংস্কার করা হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খানজাহান আলী (রঃ) ষাটগম্বুজ মসজিদ ও অন্যান্য ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদূর চট্টগ্রাম মতান্তরে ভারতের উড়িষ্যা, বিহার, রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে জলে বা পানি পথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। খামবাহ উর্দু শব্দ। অর্থ স্তম্ভ বা খুঁটি বা পিলার। কালক্রমে শব্দ বিকৃতির ফলে খামবাহ হতে গামবা আর খাম্বুজ হতে গম্বুজ হয়েছে। উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, গম্বুজ ফারসী শব্দ। জানা যায় যে, বর্তমানে ইরান, ইরাক, আফগানিস্তানে খুঁটি বা স্তম্ভ অথবা পিলারকে গম্বুজ বলে। অবশ্য কেন্দ্রীয় দরজা ও কেন্দ্রীয় মেহরাবের মধ্যবর্তী স্তম্ভ/পিলারগুলোকে উত্তর-দক্ষিণে পারস্পরিক দূরত্ব ১৬ ইঞ্চি- ৬ ফুট। তৃতীয় সারির ২টি, অষ্টম সারির ২টি একাদশ সারির ১টি স্তম্বের/পিলারকে পাথর চারদিক ইট দ্বারা আবৃত স্তম্ভ বা পিলারগুলো ১১ ফুট-উঁচু। মোট ৫টি স্তম্ভের বা পিলার বা পাথরের চারদিক ইট দ্বারা আবৃত ও ইটের উপরে স্থানে স্থানে লাইম পানিং এর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যা দ্বারা অনুমান করা হয় যে, বাকি ৫৪টি পিলার ও (একটি ব্যতিক্রম যা বর্তমানে আদি অবস্থান দন্ডায়মান) ইটের আবরণ ও তার ওপর লাইম পানিং এর আচ্ছাদন ছিল। সাম্প্রতিক সংস্কার কাজে তা অনুসরণ করা হয়। এই ৬০টি পাথরে তৈরি/স্তম্ভ চার পার্শ্বের ইটের তৈরি দেয়ালের ওপর মসজিদের ৭৭টি গম্বুজ নির্মিত। মসজিদের উত্তর দক্ষিণে ১১ ভাগে বিভক্ত। উত্তর ভাগের (পূর্ব-পশ্চিমে ৭ ভাগে বিভক্ত) তৃতীয়ভাগে ১টি পিলার বা স্তম্ভ আয়তাকার বা চৌকোণা স্তম্ভ বা পিলারটির ভিতরে পাথর ও চারপার্শ্বে পাথর দ্বারা আবৃত। শুধু ১টি স্তম্ভ বা পিলার ও ১টি কেন্দ্রীয় মেহরাব প্রায় ছয়শত বছরের প্রাচীন হিসেবে পর্যটক বা দর্শনার্থীগণের প্রদর্শনের জন্যে রেখে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথ ও কেন্দ্রীয় মেহরাবের মধ্যবর্তী স্থানের ওপরে যে ৭টি আচ্ছাদন আছে, সেগুলো বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের আকারে নির্মিত। এগুলোর তলদেশ বর্গাকৃত এবং প্রত্যেক বাহু প্রায় ১৬ ফুট লম্বা। এই ৭টি আচ্ছাদনের দু’পাশে ৩৫টি করে ৭০টি গম্বুজ আছে সেগুলো অর্ধগোলাকার। এই গম্বুজগুলোর ব্যাস ১২ ইঞ্চি, ৯ ফুট, এই চৌচালা ধরনের আচ্ছাদন পরবর্তীকালে নির্মিত দরসবাড়ি মসজিদ, ছোট সোনামসজিদ এবং আরও অনেক ইমারত দেখা যায়

তথ্য সুত্রঃ প্রত্নতত্ন বিভাগ ও পর্য টন কর্পোরেশন ওয়েবসাইট ও দৈনিক সংগ্রাম (অনলাইন)।

About Sabuj Vumi Editor

Check Also

সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরন ইতিহাস

সাতক্ষীরা জেলার নামকরন ইতিহাস : সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ প্রসঙ্গে কয়েকটি মত প্রচলিত আছে । এর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *