লক্ষ্মীবাজার: লক্ষ্মীবাজার এলাকাটি আগে ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৭৩০ সালের দিকে কাশ্মীর থেকে মিয়া সাহেব আবদুর রহিম রিজভী এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৪৫ সালে তার মৃত্যুর পর এখানেই মাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে এই এলাকাটি মিয়া সাহেব ময়দান নামেই পরিচিত হয়ে এসেছে। পলাশী যুদ্ধের পর ভিকান ঠাকুর নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কার্য পরিচালনা করতেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কেম্পানির একজন বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি কোম্পানির দেওয়ানি পদ লাভ করেছিলেন। এ সুযোগে তিনি বেশ জমিজমার মালিক হয়ে বিরাট জমিদার হয়ে যান। তার জমিদারির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বন্দরটি অন্যতম। পরে তারই প্রচেষ্টায় ইংরেজদের সহায়তায় ১৮৯০ সালে মিয়া সাহেব ময়দান এলাকাটি লক্ষ্মীদেবীর নামানুসারে নামকরণ করা হয় লক্ষ্মীবাজার।
কলতাবাজার: কলতাবাজার ঢাকার একটি প্রাচীন মহল্লা। মহল্লাটির নাম কলতাবাজার কেন রাখা হয়েছিল তা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না। এখানে ঢাকায় সর্ব প্রথম বরফ কল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অনেকেই ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বরফ কল নামে এলাকার কিছু অংশকে পরিচয় দিত। পরে ঢাকায় অনেক স্থানে বরফকল স্থাপন হলেও বরফকল এলাকা বলতে কলতাবাজারের একটি অংশই বুঝত। সেই বরফকল নামটি অপভ্রংশ হয়ে বরফ শব্দটি উঠে গিয়ে শুধু কল থেকে কলতাবাজার নামের উৎপত্তি।
নয়াবাজার: ব্রিটিশ শাসনামলের কোনো এক সময়ে মি. ইংলিশ (বা ইংলেশ) ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। তারই নামানুসারে ইংলিশ রোডের নামকরণ হয়েছে। কিন্তু শব্দ বিভ্রাটে অনেকেই মনে করেন এই অঞ্চলে কোনো এক সময়ে ইংরেজদের বসতি ছিল। তাই এই রাস্তার নাম ইংলিশ রোড রাখা হয়েছে। ফ্রেঞ্চ রোডের বেলায়ও অনেকে এরূপ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাদের ধারণা ফরাসি বসতি স্থাপনকারীদের স্মরণেই রাস্তাটির নাম ফ্রেঞ্চ রোড রাখা হয়েছে। আসলে ১৯১৮ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন মি. এফসি ফ্রেঞ্চ। তারই নামানুসারে এ রাস্তার নাম ফ্রেঞ্চ রোড। এই রাস্তা দুটোর নাম ইংলিশ রোড ও ফ্রেঞ্চ রোড হলেও জনসাধারণের কাছে এ অঞ্চলটি নয়াবাজার নামে পরিচিত। এখানে নতুন একটি বাজার স্থাপন করা হয়। এই বাজারটি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নয়াবাজার নামে পরিচিত। ১৯২৮ সালে ঢাকা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ধীরেন্দ্র চন্দ্র রায়ের নামানুসারে নয়াবাজারের একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে ধীরেন্দ্র চন্দ্র রায় রোড।
নাজিরাবাজার: পুরান ঢাকায় মুঘল সুবেদারির আমলে সরকারি বিভিন্ন দফতরের নাজিররা যেখানে বসবাস করতেন সেখানেই তাদের একজন বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই ওই এলাকাটির নাম নাজিরাবাজার বলে পরিচিত হয়ে আসছে।
বাবুবাজার: বাবুবাজার ও মোগলটুলির কিছু অংশ পাকুড়তলি নামে অভিহিত হতো। এককালে পাকুড়তলির পূর্ব অংশজুড়ে একটি বাজার ছিল। কথিত আছে, বাজারটি নাকি ভূকৈলাসের হিন্দু জমিদাররা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ জন্য এলাকাটি তাদের নামানুসারে বাবুবাজার নামে পরিচিত হয়ে আসছে। এই জমিদারের বাড়ি ছিল কলকাতার ভূকৈলাসে।
ঠাটারি বাজার: ঠাটারি শব্দটির অর্থ হলো বৃহৎ চক্র বা এক প্রকার বড় রথ বা যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রতিবন্ধক রূপে সৈন্য বাহিনীর সম্মুখভাগে ব্যবহৃত হতো। এর আড়ালে সৈন্যদল দুর্গ আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতো। মনে করা হয় এখানে এই ধরনের বৃহৎ চক্র বা রথ তৈরি হতো, আর তৈরিকারকদের ঠাটারি বলে চিহ্নিত করা হতো। সেই কারণেই এলাকাটি ঠাটারি বাজার নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। পূর্বে এ স্থানটি পিতল, তাম্র, কাসা ইত্যাদি ধাতব দ্রব্যের পাত্র তৈরিতে প্রসিদ্ধ ছিল। পরে ১৮৫০ সালের দিকে এখানে একটি বাজার নির্মাণ করা হয়। এই একই সময় কোনো এক ইংরেজ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেনের নামানুসারে হয় ক্যাপ্টেন বাজার। যা ঢাকাবাসী কাপ্তান বাজার নামে অভিহিত করে আসছে।
চকবাজার: চকবাজারকে আগে গ্রামাঞ্চলের বহু লোক চৌক বন্দর বলে আখ্যায়িত করত। মুঘল আমল থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এটা একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল এবং এটি সবার কাছে পাদশাহী বাজার বলে পরিচিত ছিল। ১৭০২ সালে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই পাদশাহী বাজারটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক বাজারে পরিণত করেন। এই বাজারের ভিত্তিপ্রস্তরটি কলকাতার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। মুর্শিদ কুলি খাঁ (দ্বিতীয়) পরে ওয়াল্টার সাহেব নতুন করে চকবাজার তৈরি করেন। তিনি সে সময়ে কোমর পর্যন্ত উঁচু দেয়াল দিয়ে চকবাজার ঘিরে দিয়েছিলেন। বাজারে প্রবেশের জন্য ১৬টি গেট তৈরি করে দিয়েছিলেন।
মৌলভীবাজার: ঢাকার অন্যতম বিশিষ্ট জমিদার মৌলভী আবদুল আলী চক বাজারের নিকটে এক গলিতে বসবাস করতেন। তিনি বাজারটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাই তারই নামানুসারে আজো বাজারটি মৌলভীবাজার নামে পরিচিত হয়ে আসছে।
বেগম বাজার: সুবে বাংলার দেওয়ান করতালো খাঁ ওরফে মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭০৩ সালে মুঘল স্থাপত্যকলায় বেগম বাজারের সঙ্গে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এর সঙ্গেই একটি মেছোবাজারও প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাজারের আয় দিয়ে মসজিদটির খরচপত্র বহনের জন্য তিনি বাজারটি মসজিদের নামে ওয়াকফ করে যান। নায়েব নাজিম নওয়াব সফররাজ খাঁর কন্যা লাভলী বেগম ১৭৭৭ সালে এই মসজিদ ও বাজারের কর্তৃত্ব নিজ দখলে নেন। এই খালেই বিবাদ-বিসংবাদের ফলে বাজারটিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। তারপর বাজারটি সরকারের তত্ত্বাবধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং লাভলী বেগমের কন্যা পান্নি বেগম ও হাজী বেগমকে বাজারের আয় থেকে কিছু ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা হয়। এই মসজিদের শেষ মুতওয়াল্লি ছিলেন হাজী বেগম। লাভলী বেগমের নামানুসারে এ এলাকার নাম হয় বেগম বাজার।
মগবাজার: ইংরেজ, গ্রিক ও ফারসিদের নামে ঢাকায় যেমন রাস্তাঘাট রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন বিদেশি ব্যক্তি ও গোত্রের নামেও ঢাকায় কিছু রাস্তা রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে মগদের বহু উল্লেখ রয়েছে। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে মগরা মুঘল সুবা বাংলার কেন্দ্রস্থল ঢাকা শহরে আক্রমণ চালায়। মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ মগদের তখনকার ঘাঁটি চট্টগ্রাম এলাকা জয় করেন। সেখানকার মগ শাসক মুকুট রায় ও তার অনুসারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইসলাম খাঁ তাদের ঢাকা শহরের এই এলাকায় বসবাস করার অনুমতি দেন। অবশ্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এ ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত দেন। তার মতে, ব্রিটিশ শাসনামলে তদানিন্তন বাংলায় মগ সর্দার কিং ব্রিং ও তার অনুসারীদের এই এলাকায় বসবাসের কারণে নামটি হয়েছে মগবাজার।
মিরপুর: এককালে এই এলাকায় বসত ছিল মীর সাহেবের। তার নামানুসারেই গোটা এলাকা পরিচিত হয়েছে মিরপুর নামে। তবে এখানে যে নদী বন্দর রয়েছে, মুঘল আমলে তা ছিল শাহ বন্দর নামে খ্যাত। আর পাক আমলে এলাকাটি অবাঙালি অধ্যুষিত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা শত্রুমুক্ত হলেও ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বাধীন হয় মিরপুর।
সোবহানবাগ: সোবহানবাগ এলাকাটি বৃটিশ আমলে ছিল ধানক্ষেতে পরিপূর্ণ। পুরান ঢাকার ইসলামিয়া লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ডেপুটি প্রশাসক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদিলের পিতামহ মাওলানা আবদুস সোবহান এলাকাটি কিনে একটি বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামেই এলাকাটির নামকরণ করা হয়। বর্তমান সোবহানবাগ মসজিদটি শুরুতে ছোট করে তিনিই নিজ খরচেই নির্মাণ করেছিলেন। তখন মসজিদের পাশে একটি পুকুরও খনন করা হয়েছিল। ১৯৪০ সালে মাও. আবদুস সোবহান মারা গেলেও তার নামটি রয়ে গেছে।
আরো দেখুন: বাংলাদেশের ৬৪ জেলা উপজেলা সহ বিভিন্ন স্থানের নামের ইতিহাস
ফার্মগেট: ব্রিটিশ সরকার কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন গবেষণার নিমিত্তে একটি ফার্ম বা খামার নির্মাণ করেছিল এই এলাকায়। সেই ফার্মের গেট বা প্রধান ফটকের নামানুসারেই গোটা এলাকার নাম হয়ে যায় ফার্মগেট।
গুলিস্তান: ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিংয়ের তালিকায় গুলিস্তান নামের কোনো জায়গার নাম নেই বরং এলাকার কেতাবী নাম বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। গুলিস্তান শব্দটির শাব্দিক অর্থ “ফুলের বাগান”। আজকের গুলিস্তানে ফুলের বাগান কিংবা গুলিস্তান সিনেমা হল, কোনটিই নেই। কিন্তু মানুষের মুখে মুখে নামটি রয়ে গিয়েছে।
পানিটোলা: যারা টিন-ফয়েল তৈরি করতেন তাদের বলা হত পান্নিঅলা। পান্নিঅলারা যে এলাকায় বাস করতেন তাকে বলা হতো পান্নিটোলা। পান্নিটোলা থেকে পানিটোলা।
বাহাদুর শাহ পার্ক: ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের নায়কেরা মহারানী ভিক্টোরিয়ার নামে থাকা এই উদ্যানের নামটি বদল করে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ (জাফর) এর নামে নামকরণ করে।
ডিস্টিলারি রোড: ধূপখোলার উপর দিয়ে যে লম্বা রাস্তাটি চলে গেছে এটিই ডিস্টিলারি রোড। এমন নামকরণের কারণ, ব্রিটিশ আমলে সেখানে ছিল সরকারি ডিস্টিলারি বা মদ্য উৎপাদনকেন্দ্র ও শোধনাগার। সহজ বাংলায় যাকে বলে ভাটিখানা। ধোলাইখাল থেকে পানি উত্তোলন করে তাই দিয়ে মদ উৎপাদন করা হতো এই ভাটিখানায়।
মতিঝিল: মুঘল আমল থেকেই একটি প্রসিদ্ধ এলাকা হিসেবে এর পরিচিতি। মতিঝিল একসময় মীর্জা মোহাম্মদের মহলের জন্য সুপরিচিত ছিলো। মহলের মধ্যে ছিলো একটি পুকুর। যা“মোতির ঝিল” নামে পরিচিত। এই ঝিলটির জন্যই এলাকাটিকে মতিঝিল নামকরণ করা হয়।
যাত্রাবাড়ি: যাত্রাবাড়ি এক সময় ছিলো নিভৃত পল্লী। তখন যাত্রাবাড়িসহ বিশাল এলাকা ব্রাহ্মণচিরণ নামে পরিচিত ছিলো। এলাকাটির একটি বাড়িতে নিয়মিত যাত্রাপালা হতো, যার কারণে সেটি যাত্রাবাড়ি নামে পরিচিত ছিলো। সেই থেকে এলাকাটি যাত্রাবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
নীলক্ষেত: ব্রিটিশরা এদেশে আসার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নীলচাষ শুরু করে। সেসময় ঢাকার বর্তমান নীলক্ষেতের বিশাল এলাকাজুড়ে নীলের চাষ হতো। তখন থেকে লোকমুখে এলাকাটি নীলক্ষেত নামেই পরিচিতি পায়। ইতিহাস ঐতিহ্য ঢাকা। রক্ষা করাটা আমাদের দায়িত্ব।
তথ্য সুত্র: মানবকন্ঠ ও ফেসবুক হতে সংগৃহিত