নেত্রকোনা জেলার নামকরণ ইতিহাস:
কেউ কেউ মনে করেন, মগরা ও কাংশ নদী পরিবেষ্টিত এই নেত্রকোনা জেলা চোখ বা নেত্রের মতো দেখতে বলেই এমন নামকরণ। জনশ্রুতি আছে, নেত্রকোনা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মগরা নদীর বাঁক চোখের বা নেত্রের কোণের মতো বলে এই জায়গার নামকরণ হয়েছে ‘নেত্রকোনা’। বিলু কবীরের লেখা ‘বাংলাদেশের জেলা: নামকরণের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নাটোরকোণা গ্রামটি বর্তমানে নেত্রকোনা জেলা শহরের সাত-আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। একসময় প্রশাসনিক কাজকর্ম নাটোরকোণা গ্রামেই চলতে থাকে। এই ‘নাটোরকোণা’ নামটিই কালের পরিক্রমায় ‘নেত্রকোনা’ উচ্চারণরূপ ধারণ করে।
বারহাট্টা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
বারহাট্টা শব্দটি এসেছে বরোহাটি এবং বৌহাটি নামের গ্রাম দুটির নাম থেকে। ফকির আন্দোলন দমন করার জন্য ইংরেজ বাহিনী এই অঞ্চলে আগমন করে। ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর পদচারণায় ও সৈন্য শিবির স্থাপনে গ্রামগুলো মুখর হয়ে ওঠে। এতে করে ইংরেজ বাহিনী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বৌহাটী ও বরোহাটী গ্রামের অদূরে নৌ-যোগাযোগের সুবিধার্থে বরোহাটী বা বৌহাটী গ্রামের নামকরণের অনুকরণে গড়ে তোলে অপর জনপদ, যা তৎকালে Brahatta নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে সেই Brahatta বারহাট্টা নামে পরিচিতি পেলেও বারহাট্টা রেলস্টেশনের নাম ফলক প্রাচীন Brahatta নামের স্মৃতি বহন করে চলছে। এছাড়াও বলা হয়, এককালে এই এলাকায় বারটি সাপ্তাহিক হাট বসত। যা থেকে এলাকার নাম বারহাট্টা নামে পরিচিত হয়।
পূর্বধলা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
পূর্বধলা নামকরণের সঙ্গে এই এলাকার রাজধলার নাম সম্পর্ক যুক্ত।পূর্বধলা নামটি এসেছে এই এলাকায় অবস্থিত ‘রাজধলা’ নামক বিলের নাম থেকে। কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, এই বিলে বহুকাল পূর্ব থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কচুরি পানা বা আবর্জনা জন্মায় না। তাই গ্রামের লোকজন আঞ্চলিক ভাষায় একে ‘ধলী বিল’ বলতো। গ্রামীণ ভাষায় ধলী শব্দের অর্থ স্বচ্ছ বা পরিষ্কার। স্থানীয়ভাবে ‘ধলা’ শব্দটি সাদা বা স্বচ্ছ অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুপেয় পানি এবং মনোরম পরিবেশ বিরাজ করায় এই বিলের পাড়ে জমিদারদের বসতি গড়ে ওঠে এবং তারা আভিজাত্য রক্ষার্থে জনসাধারণের ব্যবহার থেকে বিলের পানি সংরক্ষিত করে ফেলে। পরবর্তীতে ঐ ধলী বিল রূপান্তরিত হয়ে লোকমুখে ধলাবিল নামে পরিচিত হয়। রাজধলা বিলের দক্ষিণ-পূর্ব তীরে জমিদার বাড়ি। বিলের নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায় ‘রাজ’ শব্দটি। ঐ জমিদার বাড়ির পূর্বাংশের জলাভূমিসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নামকরণ হয় পূর্বধলা।
কেন্দুয়া উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
একটি জনশ্রুতি আছে. আরব ইয়েমেনের অন্তর্গত ‘কেন্দা’ নামক স্থান থেকে একজন ধর্মপ্রচারক কেন্দুয়ায় আসেন। তিনি পাশাপাশি অবস্থিত কান্দাপাড়া, কেন্দুয়া ও বিপ্রবর্গ এই তিনটি গ্রামে ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। এই দরবেশের স্বদেশভূমি ‘কেন্দা’ নামটি কালক্রমে বিকৃত হয়ে কেন্দুয়া নামের উদ্ভব হয়। অপর জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, পারস্যবাসীরা এ অঞ্চলে এসে সবুজ গাঁয়ের বাঈজিদের সঙ্গীত ও নৃত্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তাদের ভাষায় সেই বাঈজিদের বাসস্থানটিকে তারা ‘কান্দ ওয়া’ বলে সম্বোধন করতো। ফারসি কান্দ ওয়া শব্দটির অর্থ সবুজভূমি। সেই ফারসি কান্দ ওয়া থেকে উচ্চারণ বিভ্রাটে কেন্দুয়া নামের উদ্ভব। স্থানীয় জনৈক লেখকের লেখা থেকে জানা যায়, দু’টি স্থানকে কেন্দুয়া বুঝায়। একটি বাঈজিদের বাসস্থান, অপরটি বর্তমান থানা সদর। Ken ইংরেজি শব্দ, যার অর্থ দূর থেকে চেনা এবং ডিউ ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ ‘দু’। তাই দু শব্দের একশব্দে রূপান্তরিত হয়ে ‘কেনডিউ’ শব্দে পরিচিতি লাভ করেছে। কালের আবর্তে যা কেন্দুয়া শব্দে রূপান্তরিত হয়।
আটপাড়া উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
আটপাড়ার পূর্বনাম ব্রুজের বাজার। ব্রুজের বাজার নামটির উৎপত্তির সাথে দু’জন ব্যক্তির নাম সংশ্লিষ্ট। কেউ বলেন, ব্রুজ ফকির নামে এক সুফি সাধকের নামানুসারে ব্রুজের বাজার নামটির সূচনা হয়েছিল। অন্য একটি মতে, ময়মনসিংহ পরগণার জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর নামানুসারে এই এলাকায় ব্রজের বাজার নামে একটি বাজার গড়ে ওঠে এবং পরে সে স্থানটির নাম হয় ব্রুজের বাজার। জনশ্রুতি আছে যে, ব্রুজের বাজারের উত্তরাংশের বাজারটি এককালে হাট কিশোরগঞ্জ নামে পরিচিত ছিল। সেই হাট কিশোরগঞ্জের পশ্চিমাংশে মোবারকপুর মৌজাতে কয়েকটি জেলে পরিবারের আবাস গড়ে ওঠে। কালের বিবর্তনে সে স্থানটি হাটপাড়া নামে আখ্যায়িত হয়। সেই হাটপাড়া থেকে আজকের আটপাড়া নামের উদ্ভব। এছাড়া স্থানীয় তথ্য থেকে জানা যায়, এক সময় এই গ্রাম আটটি পাড়ায় বিভক্ত ছিল। এই আটটি পাড়া থেকে আটপাড়া নামের উৎপত্তি।
কলমাকান্দা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
কলমাকান্দার নামকরণে কয়েকটি জনশ্রুতি রয়েছে। এরকমই এক জনশ্রুতি থেকে জানা যায়- পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানির সঙ্গে পলিমাটি এসে এ অঞ্চল ভরাট ভূমিতে রূপান্তরিত হয়। এ ভরাট ভূমির স্থানীয় নাম কান্দা। কান্দায় জন্মানো কলমি গাছ জলজ উদ্ভিদ মাটি আটকে ধরে এ ভরাট ভূমিতে আরো মাটি সঞ্চয় করতে সহায়তা করে। সে কারণেই প্রথমে স্থানটি কলমিকান্দা নামে পরিচিত হয় ও পরে মানুষের মুখের ভাষায় কলমাকান্দা নামে পরিণত হয়। আরেক জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, গারো পাহাড়ে উৎপন্ন প্রচুর কমলা এ স্থানে সমতলবাসী ও পাহাড়ী গারোদের মাঝে ক্রয় বিক্রয় হতো। এ কারণে এ কান্দা অঞ্চলটি কমলাকান্দা নামে পরিচিতি লাভ করে। কালের পরিক্রমায় কমলাকান্দা অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে থাকলে তারা কমলাকান্দা কে কলমাকান্দা নামে আখ্যায়িত করে। এখন পর্যন্ত অনেকেই কলমাকান্দাকে কমলাকান্দা নামেই ডাকে।
দুর্গাপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
অনেকে মনে করেন, সোমেশ্বরী নদীর পূর্ব তীরে যে রাজবাড়ী স্থাপিত হয়েছিল সে স্থানটির নাম অধিষ্ঠাত্রী দেবী দশভূজার নামানুসারে দুর্গাপুর রাখা হয়। অন্য জনশ্রুতিটি হলো-দুর্গাপুর উপজেলাটিতে গারো হাজং এর বসবাস ছিল। যে সহানে সূসং মহারাজের রাজবাড়ী সহাপিত হয় সে স্থানটি ছিল দুর্গা নামে গারো ব্যক্তির দখলে। দুর্গা গারো অনুরোধেই এ স্থানের নামাকরণ করা হয় দুর্গাপুর।
আরো জানুন: ৬৪ জেলা উপজেলা সহ বিভিন্ন স্থানের নামের ইতিহাস
মোহনগঞ্জ উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
মোহনগঞ্জ নামকরণটি হয়েছে মোহন সাহা নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর নাম থেকে। জানা যায়, জমিদারি শাসনামলে হয়বতনগরের জমিদার শরীফ খাঁ তার জমিদারির খোঁজ-খবর নিতে এই এলাকায় আসেন। মোহন সাহা জমিদারের আগমন উপলক্ষ্যে কিছু সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে হাজির হন। আতিথেয়তায় জমিদার মুগ্ধ হন। জমিদার মোহন সাহার কাছে জানতে চান তার কোন অভিলাষ আছে কিনা! মোহন সাহা তার স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি জমিদারকে জানান, যে স্থানটিতে বসে তিনি ব্যবসা করেন সেখানে একটি হাট বসাতে চান। জমিদার শরীফ খাঁ তাকে অনুমতি প্রদান করেন এবং উৎসাহিত করেন। প্রতিশ্রুতি মত মোহন সাহা সেখানে হাট প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয়দের মধ্যে সেটি মোহন সাহার হাট বলে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে ‘মোহন সাহার হাট’ মোহনগঞ্জ নামে খ্যাত হয়।
মদন উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
মদন নামের উৎপত্তির ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। কথিত আছে, মদনা নামে জনৈক ভূস্বামীর নামানুসারে মদন নামের উদ্ভব হয়। তবে বেশির ভাগের মতে, পারস্যবাসীদের এ অঞ্চলে আগমনকালে মুদন বা মদন নামের উদ্ভব হয়েছে। ফার্সী শব্দ মুদন এর অর্থ শহর বা নগর। সময়ের আবর্তনে ‘মুদন’ শব্দটি বদলে গিয়ে মদন নামে পরিচিতি পেয়েছে। অপরদিকে ফার্সি শব্দ মদন বলতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা দন্ডায়মান হওয়াকে বুঝায়। বলাবাহুল্য, ইংরেজ সরকার কর্তৃক ১৮৩৭ সালে ব্যবহার নিষিদ্ধ হবার পূর্ব নাগাদ ফার্সি ছিল এই এলাকার রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত ভাষা।
খাসিয়াজুরী উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
এ অঞ্চলে খাসিয়াদের বাস ছিল। সে কারণে এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছিল খাসিয়াজুরী। কালক্রমে শব্দটি খালিয়াজুরীতে রূপ নিয়েছে। জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, গারো, হাজং ও কোচ শাসকদের হাত থেকে খাসিয়া সম্প্রদায় ‘জোর’ করে এই অঞ্চলের দখল নিয়েছিল বলে এর নাম হয় খাসিয়াজুরী। খাসিয়াজুরী থেকেই খালিয়াজুরী নামের বিকাশ ঘটে। আরেকটি মত হলো, পানি চলাচলের জন্য সৃষ্ট নালাকে স্থানীয়ভাবে ‘জুরি’ বলে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ জলধারা। খাল শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই মতানুসারে, খাল এবং জুরি একত্র হয়ে খালিয়াজুরী নামটির উৎপত্তি হয়েছে।