চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ ইতিহাস

চট্টগ্রাম জেলার নামকরণ ইতিহাসঃ

চট্টগ্রামের প্রায় ৪৮টি নামের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে রম্যভুমি, চাটিগাঁ, চাতগাঁও, রোসাং, চিতাগঞ্জ, জাটিগ্রাম ইত্যাদি। চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতভেদ রয়েছে। পণ্ডিত বার্নোলির মতে, আরবি “শ্যাত (খণ্ড)” অর্থ বদ্বীপ, গাঙ্গ অর্থ গঙ্গা নদী এ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। অপর এক মত অনুসারে ত্রয়োদশ শতকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে বার জন আউলিয়া এসেছিলেন, তাঁরা একটি বড় বাতি বা চেরাগ জ্বালিয়ে উঁচু জায়গায় স্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘চাটি’ অর্থ বাতি বা চেরাগ এবং ‘গাঁও’ অর্থ গ্রাম। এ থেকে নাম হয় ‘চাটিগাঁও’। আবার এশিয়াটিক সোসাইটিরপ্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্সের মতে এ এলাকার একটি ক্ষুদ্র পাখির নাম থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চট্টগ্রাম ১৬৬৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়। আরাকানীদের হটিয়ে মুঘলরা এর নাম রাখে ইসলামাবাদ। মোগলরা এর প্রশাসনিক সীমানা চিহ্নিত করে। ১৭৬০ সালে নবাব মীর কাশিম আলী খান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এটি হস্তান্তর করেন। ব্রিটিশরা এর নাম রাখে ‘চিটাগাং’।

আনোয়ারা উপজেলার নামকরণ ইতিহাসঃ

দেয়াঙে এর সামন্ত রাজা আনোপোড়মের নাম অনুসারে আনোয়ারা নামের উৎপত্তি হয়েছে। ১৫৯৩ সালে আরাকান রাজ মেঙ পলৌঙ মুসলিম নাম (সেকান্দার শাহ্) মৃত্যু বরণ করলে তার জ্যোষ্ঠ ছেলে মেঙ রাজ্যাগীমুসলিম নাম (সলিম শাহ্) আরাকানের রাজা হন (১৫৯৩-১৬১২) তার শাসন আমলে ১৬০৩ সালে দেয়াঙ এর সামন্ত রাজা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আপন ভাই আনাপোড়ম। কেন্দ্রীয় রাজার অবাধ্যতার কারনে আরাকানের রাজা আশি হাজার সন্য ও সাত হাজার রণ হস্তির এক বিশাল বাহীনি নিয়ে সামন্ত রাজা আনাপড়োম এর সামন্ত রাজ্য দেয়াঙ আক্রমণ করেন।  উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে রাজা আনাপোড়ম নিজে গুরুতর আহত হন এবং উভয় পক্ষের বিপুল সংখ্যাক লোক হতাহত হন। আরাকান বাহীনির তীব্র আক্রমণের মুখে আনাপোড়ম স্ত্রী, পুত্র, বোন অরুন্ধতীসহ পর্তুগীজ সেনাপতি গঞ্জালিশের সাথে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে পর্তুগীজ যুদ্ধ জাহাজ যোগে সন্দ্বীপ এ পলায়ন করেন। অতপর: গঞ্জালিশের সাথে বোন অরুন্ধতীকে বিয়ে দেন। ” Who Anaporam in Complianc with his Promise Paid Gonzales a lare sum of money and permitted his sister who turn christian and became the wife of the prite(Gonzales)”: Stewart History of Bangal P-236 এর কিছুদিন পর আনাপোড়ম সন্দ্বীপ এ মারা যান।  দেয়াঙ এর অধিবাসিরা তাদের প্রিয় রাজা আনাপোড়মকে হারিয়ে ক্ষোভ দু:খে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মগ সন্যদের উপর।  আনপোড়মের ধবংশ স্তুপ রাজ কার্যালয়কে কেন্দ্র করে ঐ এলাকারটির নামকরণ হয়ে উঠে আনাপোড়া। অপরদিকে রাজা আনাপোড়মের রাজ কার্যালয়ের অবস্থান স্থল আনাপোড়া, আনোপাড়া, আন্ওয়ারা, আনোওয়ারা এবং সর্বশেষ আনোয়ারা নামে পরিচিতি লাভ করে।  আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ আনোয়ার খাঁ নামক কোন মুসলমানের নাম অনুসারে আনোয়ারা নামের উৎপত্তি বলে মনে করেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য মতে, সেই প্রাচীন আরাকান আমল থেকে মোগল ব্রিটিশ শাসন আমল পর্যন্ত ‘আনোয়ারা’ নামের কোন ঐতিহাসিক নারী কিংবা ‘আনোয়ার খাঁ’ নামের কোন পুরুষের নাম ইতিহাস পর্যালোচনায় পাওয়া যায় না। এমনকি ‘আনোয়ারা’ নামক এ কাব্যিক নামটি আরাকান রাজ সভার মধ্যযুগীয় কবি কিংবা পরবর্তী কোন কবির কাব্য খুঁজে পাওয়া যায় না।যে কারনে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ আনোয়ারা নামের সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেননি। তবে আরাকানের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজা ‘আনাপোড়ম’ বহুল আলচিত একটি নাম যিনি ছিলেন তৎকালীন রোসাঙ্গ বা দেয়াঙ এর সামন্ত রাজা। সম্রাট আকবরের(১৫৭৫-১৬০৫)  অর্থ সচিব রাজা তোডরমলের ‘তকসীম জমাতে’ সরকারের ‘চাটিগাঁ’ সাতটি পরগণার উল্লেখ রয়েছে তৎমধ্যে দেয়াঙ ও একটি পরগণা। ১৭৬১ সালের ২৩ জানুয়ারি নবাব মীর কাশিম কর্তৃক ইসলামাবাদ ইংরেজদের হাতে হস্তান্তরের পর মোগল শাসন বিলুপ্ত হয়। ইংরেজরা ইসলামাবাদকে চট্টগ্রাম নামকরণ করে শাসনকার্য শুরু করেন। ১৭৭২-১৭৮২ সাল পর্যন্ত দেয়াঙ পরগণার শাসন ব্যবস্থা দেওয়ানী ও ফৌজদারি দুই পদ্ধতি পরিচালিত হয়। তখন দেয়াঙ পরগণায় ‘আনোওয়ারা মুন্সেফি আদালত’ নামে একটি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। কালেক্টর দেওয়ানি বিচারের সার্বিক তত্ত্বধায়ক হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারি ছিলেন। তাঁর অধিনস্থ দেওয়ানরা স্থানীয় সিভিল বিচারসমূহ নিস্পত্তি করতেন। ১৭৭২ সালে কমিটি অব সার্কিট পুনরায় চট্টগ্রামকে ৯টি চাকলায় বিভক্ত করেন। দেয়াঙ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। দেয়াঙ চাকলার সীমানা নির্ধারণ করা হয় এভাবে-চোয়াঞ্জা ও চাঁনখালী নালার পশ্চিমে, কর্ণফুলীর পূর্বে ও দক্ষিণে, বঙ্গোপসাগরের পূর্বে শঙ্খ নদীর উত্তরে। ১৭৭২ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত দেয়াঙ পরগণা বা দেয়াঙ চাকলায় দেওয়ান হিসেবে যে কয়জনের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন: বড়উঠানের দেওয়ান মনোহর আলী খান, দেওয়ান হোসাইন খান, পরৈকোড়ার লালারাম রায়, কালী চরণ রায়, গৌরী সংকর রায়, দেওয়া বৌদ্ধ নাথ, আনোয়ার আলী খান প্রমুখ। ১৮৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর ইংরেজ সরকার পুনরায় এক ফরমান বলে দেয়াঙ চাকলাকে দ্বি-খন্ডিত করেন। এক অংশে আনোওয়ারা, বারখাইন, হাইলধর, পরৈকোড়া, বটতলী, বরুমচড়া, রায়পুর, বৈরাগ, বারশত ইউনিয়ন নিয়ে ৬৬ বর্গমাইল এলাকার সমন্বয়ে পূর্ব নাম আনোওয়ারা থেকে ‘ও’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘আনোয়ারা’ থানা নমকরণ করে।

বাঁশখালী উপজেলার নামকরণ ইতিহাস ঃ

এ উপজেলার নামকরণ নিয়ে ২টি ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন যে, এ উপজেলার সাঙ্গু নদী ও জলকদের খাল দিয়ে এক সময় প্রচুর বাঁশ ভেলার মত বানিয়ে আনা নেওয়া করা হত। এ থেকে এ উপজেলার নাম দেওয়া হয়েছে বাঁশখালী। আবার প্রচলিত আছে যে, একবার গ্রামীন কলহের জের ধরে এক লোক কে মেরে তার মাথা একটি বাঁশের উপর ঝুলিয়ে রাখা হয়। থানায় নালিশ দেওয়া হলে থানা হতে পুলিশ গিয়ে দেখে যে, বাঁশের মাথায় সেই মাথাটা আর নেই। এ থেকে এ উপজেলার নাম দেওয়া হয় বাঁশখালী।

চন্দনাইশ উপজেলার নামকরণ ইতিহাসঃ

চন্দনাইশ চট্টগ্রাম জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। চন্দনা্ইশের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রবাহমান। উপজেলার পূর্বাংশে বিস্তৃত  এলাকা জুড়ে রয়েছে বৃক্ষে আচ্ছাদিত পাহাড় ও বনজ প্রকৃতি কোন এক সময় এ অঞ্চল তথা দক্ষিণ চট্টগ্রাম বঙ্গোপসাগরের গর্ভে ছিল। প্রায় ২ হাজার বছর আগে এ স্থানের উদ্ভব ঘটে। আরাকান মগ শাসনামলে এটি ছিল একটি সামুদ্রিক বন্দর। উপজেলার মুন্সেফ বাজারে বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হতে আগত বণিকেরা এ অঞ্চলে উৎপাদিত সুদৃশ্য ও সুগন্ধী চন্দনের আঁশযুক্ত কাঠের ব্যবসা করত। কথিত আছে চন্দন কাঠের নামানুসারে  এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় চন্দনাইশ।

ফটিকছড়ি উপজেলার নামকরণ ইতিহাসঃ

ফটিক অর্থ স্বচ্ছ ও ছড়ি অর্থ পাহাড়িয়া নদী, ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী, ঝর্ণা বা খাল। উপজেলার পশ্চিমাংশে ফটিকছড়ি খাল নামক একটি স্বচ্ছ ঝর্ণা আছে।  নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরা খালটি সীতাকুণ্ড পাহাড়ী রেঞ্জ  থেকে উৎপন্ন হয়ে যোগিনী ঘাটা নামক স্থানে হালদা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। একসময় ফটিকছড়ি উপজেলার অবস্থান ছিল ভূজপুরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই ফটিকছড়ি খালের তীরে।  ফটিকছড়ি খাল হতেই এই থানার নামকরণ হয়।

হাটহাজারী উপজেলার নামকরণ ইতিহাসঃ 

হাটহাজারী উত্তর চট্টগ্রামের এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে হাটহাজারীর নামকরণ করা হয়। এর পূর্ব নাম ছিল আওরঙ্গবাদ। বর্তমান হাটহাজারী, উত্তর রাউজান ও ফটিকছড়ি নিয়ে আওরঙ্গবাদ গঠিত। আওরঙ্গবাদ পরগনায় চট্টগ্রামে মোগল শাসনাধীন হওয়ার পর থেকেই মসনদধারী প্রথা চালু করে বারজন হাজারীকে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব বন্টন করা হয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কারণে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের আদেশ অমান্য ও অগ্রাহ্য করে হাজারীগণ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে থাকেন এবং নবাবের বিরুদ্ধাচরণ করেন। চট্টগ্রামে নবাবের প্রতিনিধি মহাসিংহ হাজারীগণের ক্ষমতা খর্ব করতে এক কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করে সীতাকুন্ডে নবাবের কাচারিতে দাওয়াত নিয়ে যান।  তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে আটজন হাজারীকে বন্দি করতে সমর্থ হন। বারজন হাজারীর মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুইজন নবাবের বশ্যতা স্বীকার করায় তাঁদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি দশজনের মধ্যে আটজনকে বন্দি অবস্থায় মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দুইজন হাজারী পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। মুর্শিদাবাদের নবাব আটজন হাজারীকে লোহার পিঞ্জরে বন্দি করে গঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে হত্যার আদেশ দেন। ফলে উত্তর চট্টগ্রামে হাজারীদের ক্ষমতা খর্ব হয়ে পড়ে। বেঁচে যাওয়া হাজারীদের মধ্যে বীরসিংহ হাজারী যে হাট প্রতিষ্ঠা করেন তাকেই আজকের হাটহাজারী বলা হয়। তখন ফারসি ভাষা প্রচলন ছিল বলে এই হাটটি “হাটে হাজারী” বা “হাটহাজারী” নামে পরিচিতি লাভ করে।

লোহাগড়া উপজেলার নামকরণ ইতিহাসঃ 

লোহাগাড়া নামকরনের পিছনে জনশ্রূতি আছে যে, এখানে লোহাগাড়া দীঘির পাড়ে শায়েস্তা খা তৎপূর্বে কিছু সংখ্যক সৈন্য রাত্রি যাপনের জন্য অবস্থান নেয়। তাদের নিরাপত্তার জন্য তারা তাদের অদূরে চারদিকে কামান দ্বারা পরিবেষ্টিত করে রাখে।  লোহার কামানের এ অবস্থান পরবর্তীতে লোকজন লোহাগাড়া হিসেবে আখ্যায়িত করে আসে। এভাবেই সম্ভবত এ উপজেলার নামকরন লোহাগাড়া হয়।

সন্দ্বীপ উপজেলা  নামকরণ ইতিহাসঃ 

মেঘনার ললাটে সাগরের টিপ-দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। তিন সহস্রাধিক বৎসরের প্রাচীন এই দ্বীপের নাম করণের বিষয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত থাকলেও সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য মতটি হচ্ছে-আদিতে এটি ছিল চারিদিকে অথৈ জলরাশি পরিবেষ্টিত একটি বিরাট ’’বালিরস্তুপ’’- ইউরোপীয়দের ভাষায় ‘‘স্যান্ডহিপ’’ ‘‘Sandheap” । কালক্রমে এই ‘‘স্যান্ডহিপ’’ শব্দটি থেকেই সাগর কন্যার নাম হয়েছে ‘‘সন্দ্বীপ’’। কথিত আছে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বারজন আউলিয়া বাগদাদ হতে মৎস্য পৃষ্ঠে আরোহণ করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওয়ানা হন। পথে নামাজের সময় হয়। কোথায় নামাজ পড়বেন এই চিন্তা উদয় হওয়া মাত্রই তাঁরা একটা দ্বীপ দেখতে পান। সমুদ্রের মাঝে একমাত্র দ্বীপ বলে একে তারা ‘‘শুন্যদ্বীপ’’ আখ্যা দেন। এই শুন্যদ্বীপই আজকের সন্দ্বীপ। কালের বিবর্তনে এটি শুন্যদ্বীপ বা সন্দ্বীপ এ পরিবর্তিত হয়। সন্দ্বীপ নাম উৎপত্তির আরও বহু ধারণা পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ইউরোপীয়রা যখন এদেশে আসেন তখন সন্দ্বীপ বালির সত্মূপের মত দেখাতো বিধায় তাঁরা একে তাঁদের মাতৃভায়ায় ‘‘Sandheap” বা বালির স্ত্তপ বলেছিলেন।  উক্ত ‘‘Sandheap” হতে পরিবর্তিত হয়ে সন্দ্বীপ নামের সৃষ্টি হয়। বাখরগঞ্জের ইতিহাস লেখক বেভারেজ সাহেব সোমদ্বীপ হতে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে উলেস্নখ করেছেন। আবার কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ আখ্যা প্রদান করেন।  উক্ত স্বর্ণদ্বীপ হতে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।

সাতকানিয়া উপজেলা নামকরণ ইতিহাসঃ 

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রশাসনিক ও বিচার কাজের স্বার্থে এই এলাকায় আদালত ভবন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে বর্তমানে অবস্থিত আদালত ভবনের নামে ০৭ কানি ভূমি (৪০ শতকে ১ কানি) জনৈক পেটান নামক এক জমিদার সরকারের অনুকূলে হস্তান্তর/দান করায় তৎসময় হতে এ উপজেলার নামকরণ সাতকানিয়া হয় মর্মে জনশ্রুতি আছে

সীতাকুন্ড উপজেলা  নামকরণ ইতিহাসঃ 

সীতাকুন্ন্ডের নামকরন সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী আছে।  ইতিহাসের দৃষ্টিকোন থেকে  নামকরনের সত্যতা সম্পর্কে জোরালোভাবে কিছু  বলা যাবে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে  মনে   করেন রামায়ন বর্ণিত সীতা এখানে আগমন  করেন এবং একটি কুন্ডে স্নান করেন ।সেই  হতে  সীতাকুন্ডে নামের উৎপত্তি। কারো কারো মতো  রাম স্বয়ং তার পত্নীর নামেই সীতাকুন্ড নাম  করন করেন। আবার কেহ কেহ মনে করেন দক্ষ রাজার মহাযজ্ঞের সময় ক্ষিপ্ত উম্মত্ত শিব তার পত্নী  সতীর শবদেহ খন্ড বিখন্ড করেন এবং তার নামানুসারে সীতাকুন্ড কালের বির্বতনে বিকৃত  হয়ে  সীতাকুন্ড হয় । অর্থ্যাৎ হিন্দু ধর্মের পুরাণিক উপাখ্যানে নারদ মুনির ভূমিকা সর্বজন বিদিত। নারদ মুনির ভূমিকা  থেকে স্পষ্ট হয়  যে দক্ষ নরাজার কন্যা পার্বতী মা বাবার অগোচরে ভালবেসে বিয়ে করেন শিবকে এতে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে ত্রি-ভূবনের সবাইকে আমন্ত্রন জানালেন। সেখানে শিবকে অপদস্ত করার জন্য তার মূর্তি বানিয়ে  রাজপ্রাসাদের তোরনের বাহিরে প্রহরী হিসাবে রাখা হল। নারদ মুনি থেকে পার্বতী একথা  জানতে পেরে নিজেই প্রত্যক্ষ করলেন এবং লজ্জায় অপমান দেহত্যাগ করলেন। পার্বতী বেচে নেই জেনে  উম্মত্তপ্রায়  শিব  পার্বতীর মৃতদেহ মাথায়  নিয়ে প্রলয় নাচন শুরু করলেন। এক পর্যায়ে বাহান্ন খন্ডে খন্ডিত পার্বতীর দেহ  বাহান্ন  স্থানে  নিক্ষিপ্ত হয়ে  বাহান্নটি তীর্থ কেন্দ্রের উদ্ভব হয়।  তম্মধ্যে সীতাকুন্ডও একটি। সতী পার্বতীর উরুসন্ধীর অংশ এখানে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলে কথিত  আছে। তবে  হিন্দু ও তান্ত্রিক  গ্রন্থগুলোতে সীতাকুন্ডের নাম সুস্পষ্ট নয়।এসব উপাখ্যান বৃটিশদের  দলিল দস্তাবেজের মাধ্যমে জানা যায়।     আরও একটি তথ্য পাওয়া যায় এভাবে যে, পিতৃ আদেশে শ্রীরামচন্দ্র  পত্নী সীতা দেবী ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষনকে নিয়ে বনবাসী  হন  এবং  এখানে কিছুদিন  অবস্থান করেন ।  সে সুবাধে তাদের নামানুসারে  স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরের পাদদেশে রামকুন্ড,  লক্ষণকুন্ড,সীতাকুন্ড নামে  তিনটি কুন্ড  এবং একটি সীতার মন্দির ও বিদ্যামান ।১৭৬১ সালের ৫ জানুয়ারী চট্টগ্রামের প্রথম ইরেজ চীফ নিযুক্ত  হন হ্যারী  যাত্রা বিরতিকালে  সীতাকুন্ড ক্যাম্প হতে পোর্ট উইলিয়ামের নিকট  তিনি যে চিঠি  লিখেন তাতে  সীতাকোন নামে  উল্লেখ দেখা  যায়।

চট্টগ্রাম কেন চিটাগং?

প্রজাতির উৎপত্তির যেমন বিজ্ঞানসম্মত কার্যকারণ রয়েছে, তেমনি অন্য অনেক কিছুর মতো কোনো দেশের নামকরণের পেছনেও রয়েছে কার্যকারণলব্ধ উৎপত্তির ইতিহাস। ইতিহাসের ক্রমান্বয়িক ধারায় দেখা গেছে শাসক ও শাসনব্যবস্থা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলের নামেরও পরিবর্তন হয়েছে। সেই বদল হয়েছে শাসকের ইচ্ছানুযায়ী। আবার শাসনের ক্রমবিবর্তনে সে বদলানো নাম মুছে গিয়ে অঞ্চলটি আবার পরিচিত হয়ে উঠেছে তার পুরোনো কিংবা আদি নামে। জন্মানোর পর শিশুকে যে নাম দেওয়া হয়, সে নাম শিশুটির বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার অস্থিমজ্জায় রক্ত-মাংসে, ভাবনায় ও চৈতন্যে এমনভাবে মিশে যায় যে সে নিজেকে তা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। সে নাম তার ভালো কিংবা মন্দ কাজে ব্যাপ্ত বা সংকুচিত হয় বটে, কিন্তু তাতে তার নামের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
ইংরেজিতে চিটাগং না বলে কেন চট্টগ্রাম লেখা হবে না, তা নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু লেখার সময় এখন লিখছি চিটাগং। কেন চট্টগ্রাম নয়, তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় বোধ হয় এসেছে।  ইস্ট বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেটরসের গেজেটর অব চিটাগং ডিসট্রিক্ট বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৩ সালে।  মূল্যবান তথ্যসংবলিত সেই বইটিতে বিশদ ও সবিস্তারে চট্টগ্রামের ইতিহাস, এখানকার মানুষ, স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সেই সময়কার বেতন-ভাতাদি, বাণিজ্যের নানা খুঁটিনাটি, যাতায়াতব্যবস্থা, জমির রাজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, কৃষিকর্ম ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ এই গ্রন্থটিকে সেই সময়ের চট্টগ্রামকে বিশদভাবে জানার একটি আকর গ্রন্থ বলা যেতে পারে। এই বইটির লেখক ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের দক্ষ কর্মকর্তা এল এস এস ওম্যালি। যাঁদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, তাঁরা হলেন স্যার চার্লস অ্যালেন, যিনি ১৯০০ সালে চিটাগং সার্ভে ও সেটেলমেন্ট রিপোর্টটি তৈরি করেছেন এবং সেই সময়কার চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার এইচ লুসন সাহেব।
‘দ্য অরিজিন অব নেইম’ অর্থাৎ এই অঞ্চলের নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।  প্রথমে উদ্ধৃত করেছেন বুদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভাষ্য, চৈতকিয়াং কিংবা চৈতাগ্রাম, চৈতার অর্থ হলো বুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, সেই থেকে সম্ভবত এই অঞ্চলের নাম চট্টগ্রাম। হিন্দুমতে চট্টগ্রামের আদি নাম ছিল চট্টলা। মুসলমান শাসক অধিগ্রহণের পরে সে নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো চাটিগাঁও। মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে অর্থাৎ চাটি জ্বালিয়ে পীর বদর শাহ অশুভ প্রেতাত্মাদের তাড়িয়েছিলেন বলে এই নাম।  নবম শতকে আরাকানের এক রাজা এই অঞ্চলে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালান। জয় করার পর সেই বিজয়কে চিহ্নিতকরণের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলের কোন একটি জায়গায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। নির্মাণ শেষে রাজা যে মন্তব্যটি করেন, স্মৃতিস্তম্ভ সেই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে। মন্তব্যটি হলো, ‘তিসত- তা- গুং’ মানে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অনুচিত।
বিশ্বখ্যাত ইতিহাস ও ভূগোলবিদ ব্যারনুলি তাঁর ডেসক্রিপশন হিস্টোরিক এট জিয়োগ্রাফিক ডি লিন্ডে (১৭৮৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘শাট’ মানে বদ্বীপ এবং গঙ্গা, এই দুয়ের সংযুক্তির ফলে এই জায়গার নামকরণ হয়েছে শাটগঙ্গা, যার মানে গঙ্গার সম্মুখে গড়ে ওঠা নগরী। স্যার উইলিয়াম জোন্স অনুমান করেছেন যে এই জায়গায় একটি অনন্যসুন্দর পাখি দেখা যেত; একটি দুটি নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যেত।  পাখিটির নাম ‘ছাতগ’।  সেই থেকে বোধ করি চাটিগাঁ। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা আবার অন্য ভাষ্য দিয়েছেন, বলেছেন চতুগ্রাম থেকে কালিকপ্রবাহ ও বিবর্তনে এর নাম হয়েছে চট্টগ্রাম। তবে তার সবিস্তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলের নামের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, জনশ্রুতি, নানা কথা, উপকথা ও কিংবদন্তি। সেন্ট পিটার্সবুর্গকে কমিউনিস্ট রাশিয়া নতুন নাম দিলেন লেনিনগ্রাদ। যেই বয়ে গেল পরিবর্তনের হাওয়া সেন্ট পিটার্সবুর্গবাসীরা আদি নামটি ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি তুলল। লেনিনগ্রাদ মুছে সেই প্রাচীন নগর আবার হয়ে গেল সেন্ট পিটার্সবুর্গ। কারণ, এই নামের পেছনে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, আছে তার নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি, আছে ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্তি।
চিটাগং গ্যাজেটিয়ারে লেখক এ-ও উল্লেখ করেছেন যে ইংরেজ শাসকদের অনেক বদভ্যাসের মধ্যে একটি ছিল ‘ভালগারাইজেশন অব নেমস’ নামের বিকৃতি করা। এটা যে আমরা উপলব্ধি করিনি, তা কিন্তু নয়। ঢাকা এখন সারা পৃথিবীতে ঢাকা নামে পরিচিত, ড্যাক্কা (DACCA) নয়। বার্মা হয়ে গেছে মিয়ানমার, পিকিং বেইজিং, রেঙ্গুন ইয়াঙ্গুন, বম্বে মুম্বাই, ক্যালকাটা কলকাতা, তাহলে চিটাগং কেন চট্টগ্রাম নয়। একদিন আত্ম-অনুসন্ধানের পথ ধরে চিটাগংকেও হতে হবে চট্টগ্রাম। কারণ, এই নামের সঙ্গে কত কিংবদন্তি, কত গাঁথা–লোককথা–উপকথা মিশে আছে, কত সুখ-দুঃখের, যুদ্ধ-বিগ্রহের, বীরত্ব ও রক্তক্ষয়ের, ঝড়-তুফান ও প্লাবনের স্মৃতি আছে জড়িয়ে।
সুফি সাধকের পীর আউলিয়ার এই পুণ্যভূমির নাম চট্টগ্রামই থাকুক, এ দেশে যেমন, ভিনদেশের মানুষও ডাকুক এই নামে। তাঁরা জানুক এই প্রাচীনতম বন্দরনগর, যা ইবনে বাতুতাকে মুগ্ধ করেছিল ১৩৫০ সালে, যা আইন-ই-আকবরিতে উল্লিখিত আছে সমুদ্রপাশে সুন্দরতম নগরী বলে তার নাম চট্টগ্রাম। কেন অহেতুক চিটাগং হবে। সেই কবে আমাদের রক্ত-মাংস চিবিয়ে আমাদের ঝাঁঝরা করে দিয়ে সব লুটেপুটে চলে গেছে ইংরেজ আর আমরা এখনো সেই নাম বহন করে চলেছি। এটা ভীষণ লজ্জার। ’৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান, ’৭১-এ বাংলাদেশ, তবু ঔপনিবেশিক ভূতকে তাড়ানো গেল না। আসুন, সবাই মিলে আওয়াজ তুলি, চিটাগং নয়, এই সুন্দরতম অঞ্চলের নাম ‘চট্টগ্রাম’, বিশ্বের সবাই যেন সেই নামে চেনে, সেই নামে ডাকে…।
শান্তনু বিশ্বাস: সংগীত শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী।

About Sabuj Vumi Editor

Check Also

সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরন ইতিহাস

সাতক্ষীরা জেলার নামকরন ইতিহাস : সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ প্রসঙ্গে কয়েকটি মত প্রচলিত আছে । এর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *