শকুনি লেক। মাদারীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি কৃত্রিম লেক। এলাকার একমাত্র বিনোদনকেন্দ্র তাই নয় এটি এ অঞ্চলের দীর্ঘতম লেক হিসেবে পরিচিত। মাদারীপুর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ১৮৫৪ সালে এই শকুনী লেকটি খননের মধ্য দিয়ে মাদারীপুর শহরের পত্তন হয়।
শকুনী লেক সৃষ্টির ঐতিহাসিক বিবরণও কিংবদন্তি :
জনশ্রুতি আছে কয়েকশত বছর পূর্বে জনৈক রাজা পানির সংকট নিরসনে এই লেকটি খনন করেন। মাদারীপুরের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক সুবল বিশ্বাস গণমাধ্যমকে বলেন, গত শতকের চল্লিশের দশকে বিশাল লেকটি খনন করতে বহু মাটিকাটা শ্রমিকের দরকার হয়। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এ অঞ্চলে না থাকায় ভারতের বিহার ও ওড়িশা অঞ্চল থেকে দুই হাজার শ্রমিক আনা হয়। প্রায় ৯ মাসে লেকের খননকাজ সম্পন্ন করা হয়।
লেক সম্পন্ন হওয়ার এক পর্যায়ে আকস্মিকভাবে তলদেশ থেকে পানি উঠতে শুরু করায় শ্রমিকরা ভয় পেয়ে যায়। এ সময় বেশ কিছু শ্রমিকের ডায়রিয়া হয় ফলে ৭জন শ্রমিক মারা যায়। ভয়ে বাকি শ্রমিকরা কাজ শেষ না করেই রাতারাতি পালিয়ে যায়। ফলে পরবর্তীকালে আর কোনো শ্রমিক ব্যবহার না করেই এ লেকটি উন্মুক্ত করা হয়। এরপর বহুদিন লেকে কেউ সাঁতার কাটতে বা গোসল করতে নামেনি। তাছাড়া এ লেকে দীর্ঘদিনের রক্ষিত পুরোনো মাছ শিকার নিয়ে রয়েছে গল্প। লেকের মাছ ধরার জন্য জাল ফেলা হলে দক্ষিণ পাড়ে সার্কিট হাউজ সংলগ্ন পানির নীচে বিশাল সুড়ঙ্গে বড় বড় মাছ লুকিয়ে থাকে। কেউ সুড়ঙ্গ দেখেছে এমন তথ্য জানা যায়নি। তবুও ভীতিটা রয়ে গেছে এখনও।
ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, একসময় নগরায়ণের প্রয়োজনে লেকটি খনন করা হয়। ১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় মাদারীপুর মূল শহরের অস্তিত্ব যখন বিলীন হতে থাকে, তখন নতুন করে শহর স্থানান্তরের জন্য মাটির প্রয়োজনে ১৯৪২-৪৩ সালে এ লেক খনন করা হয়। এলাকাটি ছিল জনমানবহীন এবং বনজঙ্গলে ভরা নিম্নভূমি। নদী ভাঙন কবলিত তৎকালীন মহকুমা শহরের কোর্ট-কাছারি, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, থানা, জেলখানাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বাংলো স্থানান্তরের জন্য এলাকাটি বেছে নেওয়া হয়। সমতলে এসব স্থাপনা তৈরির জন্য প্রচুর মাটির প্রয়োজন হয়। তাই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মাদারীপুর মহকুমা প্রশাসন লেকটি খনন করে মাটির চাহিদা পূরণ করে।
শকুনী লেকের নামকরণ ইতিহাস:
১৮৭৫ সালে জমিজমার কাগজপত্রে শকুনী মৌজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সেই শকুনী মৌজায় অবস্থিত বলে স্বাভাবিকভাবেই লেকটিরও শকুনী লেক নামকরণ হয়। জন্মলগ্ন হতেই লেকটির নাম শকুনী লেক। বইপত্রে এই লেকটির নাম শকুনি লেক’ হলেও স্থানীয়রা এটিকে মাদারীপুর লেক’ হিসেবে চেনে।
বিগত কয়েক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মাদারীপুরের বিভিন্ন মহলে আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল মাদারীপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী শকুনী লেকের নাম পরিবর্তন করে ডিসি লেক’ নাম করনের বিষয়টি। মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন বিশ্বাসের মেয়াদকালে একটি মিটিংয়ে এ প্রস্তাবের সূচনা হয়। সে মিটিংয়ে উপস্থিত সুধী মহলের বেশিরভাগই নাম পরিবর্তন না করার পক্ষে কথা বলেন। সে কারণে দীর্ঘদিন সে আলোচনা স্থগিত ছিল। তবে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম তার কর্মদিবসের শেষ দিকে শকুনী লেককে ডিসি লেক নামে নামকরণের নির্দেশনা দিয়ে যান। কিন্তু বহকাল পূর্ব হতেই এই লেকটি শকুনি লেক নামে পরিচিত। এই লেকের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি এবং ঐতিহ্যবাহী এই লেকটির নাম পরিবর্তন করা হবে না।
Read More:মাদারীপুর জেলা ও এর উপজেলা নামকরণ ইতিহাস ও পরিচিতি
বর্তমান শকুনীলেক:
এই লেকের আয়তন ১ লক্ষ ১ হাজার ১৭২ বর্গমিটার, দৈর্ঘ্য ৪৮৬ মিটার ও প্রস্থ ১৯৮ মিটার।ডিসিঅফিস, পুলিশ স্টেশন, এবং বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাসহ মাদারীপুরের বেশীরভাগ স্থাপনাই এই লেকের আশেপাশে নির্মাণ করা হয়। একটি মাছ ধরার জাল দিয়ে এই বিশাল লেকটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে যার একটি অংশে মাছ চাষ করা হয়।লেকের পশ্চিম পাড়ে লেক ভিউ ক্লাব, ডিসি একাডেমি, ঐতিহাসিক জামে মসজিদ ও ময়দান, সিভিল সার্জন ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের বাসভবন রয়েছে।দক্ষিণে সার্কিট হাউস, মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভবন ও চৌধুরী ক্লিনিক। লেকের পূর্ব পাড়ে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, সদর হাসপাতাল, সিভিল সার্জন ভবন, পুলিশ লাইনস ময়দান। উত্তরে বঙ্গবন্ধু ল কলেজ, সরকারি পাবলিক লাইব্রেরি, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, শিশুপার্ক, স্বাধীনতা অঙ্গন, মাদারীপুর সরকারি সমন্বিত অফিস ভবন ও শহীদ কানন চত্বর।
শকুনি লেকে বঙ্গবন্ধুর মূর্যাল। ছবি সাননিউজ 24
গত দশকে লেকটি সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিলে ২০১৩ সালে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকটির সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। যার ফলে লেকটিকে ঘিরে লেকটি স্থানীয়দের বিনোদন, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। গত দশকে লেকটি সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিলে ২০১৩ সালে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকটির সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। যার ফলে লেকটিকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু মুরাল, শহীদ কানন, শিশু পার্ক, স্বাধীনতা অঙ্গন, এম্ফি থিয়েটার মঞ্চ, পাকা ঘাট, ওয়াচ টাওয়ারসহ দৃষ্টি নন্দন নানা উপকরণে লেকটি মাদারীপুর জেলাসহ আশেপাশে নানা অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
মাদারীপুর শহরের বিনোদন কেন্দ্র
সেদিনের সেই কৃত্রিম লেক আজ এক দৃষ্টিনন্দন সরোবর। এলাকার একমাত্র বিনোদনকেন্দ্র। বহিরাগত যে কেউ মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করেই এই লেকের মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়।
সকালের নির্মল হাওয়া আর বিকেলের পায়চারি। মাদারীপুর শহরবাসীর ক্লান্তি দূর করার অন্যতম জায়গা শকুনি লেক। একটু প্রশান্তির খোঁজে সকাল-বিকেল অনেকে ছুটে আসে কৃত্রিম এ লেকের ধারে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশাল এলাকাজুড়ে এই লেকের সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লেকটি পরিণত হয়েছে অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রে। বর্তমানে এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য মানুষের মন কেড়ে নিয়েছে।
বিকালবেলা এই লেকে এতটাই জনসমাগম হয় যে এখানে কোন খালি জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। শহরের বেশিরভাগ মানুষ পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এখানে আসেন অবসর সময় কাটাতে। লেকের নীল পানি আপনাকে প্রশান্তি দেবে। লেকটি স্থানীয়দের বিনোদন, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
২০১৭ সালে পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সাড়ে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। লেকটি হয়ে ওঠে আরও দৃষ্টিনন্দন। এখন সৌন্দর্যপিপাসু বহু মানুষ দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসে লেকের পাড়ে। এমনকি রাত ১১টা পর্যন্ত মানুষের আনাগোনা থাকে।
শকুনী লেক শুধু বিনোদন কেন্দ্রই নয় ঐতিহাসিক জনসভার ময়দান।
এ ঐতিহাসিক ময়দান ব্রিটিশ আমল থেকেই জনসভার জন্য উন্মুক্ত ছিল যা এখনও রয়েছে। এক সময় যাঁদের পদভারে এ ময়দানটি গর্বিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পির মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়া, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ।
তথ্যসুত্র: জাতীয় তথ্য বাতায়ন, জাতীয় পত্রিকা, স্থানীয় পত্রিকা বইপত্র।