Home / নামের ইতিহাস ও কিংবদন্তী / টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ

টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ

টাঙ্গাইল জেলার উপজেলা ও বিভিন্ন স্থানের নামকরণ ইতিহাস

টাঙ্গাইল জেলার নামকরণ ইতিহাস:
টাঙ্গাইল নামকরণ বিষয়ে রয়েছে বহুজনশ্রুতি ও নানা মতামত। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন।  ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে। টাঙ্গাইলের ইতিহাস প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে।

আরেক জনশ্রুতি মতে নীলকর টেংগু সাহেবের গল্পই সব চেয়ে বেশি প্রচলিত। বৃটিশ শাসনের প্রায় প্রারম্ভে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। পূর্বোক্ত দুই মৌজার সীমানা বরাবর তিনি উচু মেটোপথ বা আইল যাতায়াতের জন্য তৈরী করেছিলেন। ক’জন সাধারণ এই আইল কে টেংগু সাহেবের আইল বলে উল্লেখ করতো। সুতরাং অনুমান করা হয় যে, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামেরই অপভ্রংশ। আবার তরুণ গবেষক ইতিহাসবিদ, অনুবাদক জনাব খুররম হোসাইন তার ‘টাঙ্গাইলের স্থান নামঃ ইতিহাস ও কিংবদন্তী’নামক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে, সুবাদার শায়েস্তাখান সামরিক উর্দির নীচে ছিল যার অসাধারণ কুটবুদ্ধি আর প্রশাসনিক দক্ষতা। মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করা যখন কোন ক্রমেই সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন তাঁর চিন্তায় আসে দক্ষিণ ভারতের মালাবর অঞ্চলের মোপলাদের কথা, সমুদ্র পাড়ের এই সব মোপলা, যারা অসম সাহসী যোদ্ধা, সম্মুখ যুদ্ধে যারা কখনও পিছু হটে না, সেই সব মোপলাদের নিয়ে এলেন রংরুট করে। জলদস্যুদের উৎপাত যখন কিছুটা দমিত হলো তখন তাদের বসতির স্থান নির্ধারণ করলেন বর্তমান টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম প্রান্তে। মোপলাদের ধর্মগুরুকে তারা নিজস্ব ভাষায় তাংগাইল বলে টাঙ্গাইল এই মোপলা সম্প্রদায় আজও টিকে আছে। এই অঞ্চলের যারা নিজেদের পরিচয় দেয় মাহিফরাস বলে। মৎস্য ব্যবসা যাদের প্রধান জীবিকা। টাঙ্গাইল অঞ্চলের লোকজন তাদেরকে নিকারি বলে জানে। পূবোল্লিখিত বিষয়গুলো বিচার করে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মোপলাদের সর্দারকে যে স্থানে জায়গা দেয়া হয়েছিল সেই স্থানটিই ক্রমে টাঙ্গাইল নামে পরিচিত হতে থাকে। এমতটির পেছনে রয়েছে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণাদি।  ডঃ তারা চাঁদের “The influence of Islam on India culture”- গ্রন্থেও এ বিষয়ে সাক্ষ্য মেলে। টাঙ্গাইলের নামকরণ নিয়ে আরো বিভিন্নজনে বিভিন্ন সময়ে নানা মত প্রকাশ করেছেন। কারো কারো মতে, বৃটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র আটিয়াকে আশ্রয় করে যখন এই অঞ্চল জম-জমাট হয়ে উঠে। সে সময়ে ঘোড়ার গাড়িছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে বর্তমান টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকেরা বলত ‘টাঙ্গা’। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও এ অঞ্চলের টাঙ্গা গাড়ির চলাচল স্থল পথে সর্বত্র। আল শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে এই আল শব্দটির যোগ লক্ষ্য করা যায়।  আল শব্দটির অর্থ সম্ভবত সীমা নির্দেশক যার স্থানীয় উচ্চারণ আইল।একটি স্থানকে যে সীমানা দিয়ে বাঁধা হয় তাকেই আইল বলা হয়। টাঙ্গাওয়ালাদের বাসস্থানের সীমানাকে ‘টাঙ্গা+আইল’ এভাবে যোগ করে হয়েছে ‘টাঙ্গাইল’এমতটি অনেকে পোষণ করেন। ইতিহাসবিদ মুফাখখারুল ইসলামের মতে, কাগমারি পরগণার জমিদার ইনাযাতুল্লাহ খাঁ চৌধুরী (১৭০৭-১৭২৭খ্রিস্টাব্দ) লৌহজং নদীর টানের আইল দিয়া কাগমারী আধামাইল দূরে খুশনুদপুর (খুশির জায়গা যার সংস্কৃতায়ন করলে সন্তোষ) তাঁর সদর কাচারিতে যাতায়াতে করতেন। এই টানের আইল বা টান আইল বলিয়া বলে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত হতে হতে টাঙ্গাইল নামকরণ হয়েছে। অন্য মতবাদে জানা যায় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ সরকারের আদেশ অনুযায়ী পারদীঘুলিয়া মৌজায় অন্তর্গত আতিয়া নামক গ্রামে টান-আইল থানার সদর স্থ্পন করা হয়। গত শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালীণ সময়ে টান-আইল মৌজা টাঙ্গাইল নামের রূপান্তরিত হয়। আইল শব্দটি কৃষিজমির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শব্দটি আঞ্চলিক ভাবে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। টাঙ্গাইলের ভূ-প্রকৃতি অনুসারে স্বাভাবিক ভাবে এর ভূমি উঁচু এবং ঢালু। স্থানীয়ভাবে যার সমার্থক শব্দ হলো টান। তাই এই ভূমিরূপের কারণেই এ অঞ্চলকে হয়তো পূর্বে ‘টান আইল’বলা হতো। যা পরিবর্তীত হয়ে টাঙ্গাইল হয়েছে।অন্য একটা সূত্রে জানা যায় হযরত শাহ জামাল (রাঃ) জাহাজ যোগে এদেশে আগমন করার সময় মাদ্রাজ থেকে একদল জেলে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এদের দলপতির নাম ‘টাংগা ।  জেলেরা লৌহজং নদীর পূর্ব তীরে বসবাস শুরু করে। তাদের দলপতির নামানুসারে স্থানের নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’।  পূর্বে টাঙ্গাইল অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল ছিলো। এখানকার মানুষ বসবাসের জন্য মাটির উপর বাঁশ পুঁতে টং ঘর নির্মাণ করতো। টং ফরাসী শব্দ, অর্থ হলো উঁচু। অতীত সময়ে স্থানীয় অনার্য বাসিন্দারা বাসস্থানকে ‘ইল’বলতো। তাই কারো কারো মতে এই টংইল (উঁচু বাসস্থান) থেকে টাঙ্গাইল নামের উৎপত্তি। জনশ্রুতিতে আরো আছে যে, ব্রিটিশ আমলে নীল ব্যবসার চরম উন্নতির সময়ে বর্তমানের টাঙ্গাইল শহরে অসংখ্য টাংগা গাড়ির ভিড় লেগে থাকতো। তা থেকেই আঞ্চলিক নাম টাঙ্গাইলের উৎপত্তি। টাঙ্গাইল জেলা  গেজেটিয়ারে নামকরণ বিষয়ে সর্বাগ্রে যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নবাব শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার ছিলেন।তাঁর শাসনকালে পর্তুগীজ মগ জনদস্যুদের হামলা ও অত্যাচার বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে চরমে পেঁŠছেছিলো। শায়েস্তা খাঁ পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দাক্ষিণাত্যের মোগলদের নিয়ে এক শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠণ করে ছিলেন। কালক্রমেই এই নৌ-বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া হলে এদের অনেকেই দক্ষিণ ভারতে মালাবাদ উপকূলে প্রত্যাবর্তন না করে লৌহজং নদীর চর এলাকায় বসতি স্থাপন করে।এসব নতুন গড়ে ওঠা বসতিগুলোকে মোগলরা অভিহিত করেছিলেন দিহ্ টাঙ্গাল (দিহ্ শব্দের ফরাসী অর্থ হলো মহল্লা) যা কালক্রমে টাঙ্গাইল হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ আদম শুমারী রিপোর্ট সূত্রে জানা যায় দাক্ষিণাত্যে মালাবার সমুদ্র উপকূল এলাকায় ‘মোপলা’নামে এক জাতি বাস করত। তারা আরব বণিকদের বংশধর এবং এতদঞ্চলের মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হত। মোপলাদের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষমতাশীল ধর্মীয় নেতাদেরকে ‘তাংগাইল’বলা হতো। এসমস্ত ধর্মীয় নেতাদের নামানুসারেই পরবর্তীকালে বর্তমান ‘টাঙ্গাইল নামকরণ হয়েছে। কথিত আছে জনৈক ইংরেজ সন্তোষ জমিদারিতে ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। রাজস্ব আদায় শেষে ঢাকা যাওয়ার পথে একদল ঠগ রাজস্বের অর্থ লুটপাট করে সেই সঙ্গে ইংরেজ সাহেবকে হত্যা করে লৌহজং এর পূর্ব পারে টাংগিয়ে রেখে যায়। সেই থেকে নাম দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল।  আবার কারো করো মতে ‘টান’এবং ‘ইল’নামক দু’জন ইংরেজ সাহেব সন্তোষ জমিদারিতে এসেছিলেন থানার স্থান নির্বাচনের জন্য তাদের নামানুসারে নাম হয়েছে টাঙ্গাইল। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানের নামে ‘আইল’শব্দের আধিক্য আছে (যেমন- বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদি) অনেকের ধারণা টাঙ্গাইলের অন্য স্থানের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘটনা প্রবাহে ‘টাঙ্গাইল নাম হয়েছে।  টং শব্দের ফরাসী অর্থ উঁচু। আর আইল হচ্ছে আবাদী জমির সীমানা সংলগ্ন অংশ। টাঙ্গাইল জেলা প্রাচীনকাল থেকে পাহাড়ের উঁচু ভূমি ও নিকটবর্তী কৃষি জমির সমাহার। এই উঁচু ভূমি বা টং ও জমির ‘আইল এই দুইয়ের সমন্বয়ের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের এলাকার নাম টাঙ্গাইল হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলার উপজেলা সমুহঃ বাসাইল, ভুয়াপুর, দেলদুয়ার, ঘাটাইল, গোপালপুর, মধুপুর, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখিপুর, টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী, ধনবাড়ী

বাসাইল উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
বাসাইল নামটি টাংগাইলসহ জেলার অন্যান্য স্থানের নামদ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এমনটা ভাবা অযৌক্তিক নয়।  ডুবাইল, করাইল, নিকরাইল, বেতরাইল, কুকরাইল, মিচাইল,  বানাইল, ঘাটাইল, পাথরাইল, সাকরাইল, বাজাইল,  সেহরাইল, কোকাইল, এমন অজস্র আইলাস্ত নামের স্রোতে সুদূুর অতীতে বাসাইল নামটিও হয়তো  ভেসে এসেছে বংশাই নদীর এক ক্ষীণ স্রোতধারা বর্তমান মরাগাং বেয়ে।  তারপরও এ নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত।

1)  আইলের দ্বারা পরিবেষ্টিত বাসস্থানই হচ্ছে বাসাইল।

2)  ভূমি গঠনের প্রাক্কালে বাঁশ পুঁতে আইল নির্ধারণের কারণেই বাসাইল।

3)  জমির আইল উঁচু করে পানি সংরক্ষণের মাধ্যম শস্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকেই বাসাইল। এসব  উঁচু আইল  বর্ষায়ও  ভাসমান  বলে  প্রতীয়মান হয়। তাই ভাসা আইল থেকে বাসাইল।

4)  পার্শ্ববর্তী পাহাড়ী অঞ্চলের বাঁশ আর নিম্নাঞ্চলের শালি ধান মিলে গিয়ে বাসাইল।

5)  সুলতানী বা বাদশাহী আমলে জমির পত্তন গ্রহিতার নাম অনুসারে স্থানেরও নামকরণ হতো । যেমনঃ সাকের আলী  নাম অনুসারে  সাকরাইল,  ঘটু মিয়ার নাম অনুসারে ঘাটাইল, তেমনি বাশী মন্ডলের নাম অনুসারে বাসাইল।

6) নদী প্রভাবিত এ অঞ্চলের নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে বংশী নদী।  বংশী নদীর আইল>বংশাইল>বাসাইল। নদী আবহমান বাংলার মানুষকে সঞ্জীবনী সুধা  যোগান দিয়ে করে তুলেছে মৃত্যুঞ্জয়ী। মানুষও  নদীর প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তাদের পরম সুখের আবাস ভূমির নামের সাথে সতত সঞ্চরণশীল বংশী নদীটির নামটি অদৃশ্য সূতায় গ্রথিত করে এলাকার নামকরণ করেছে বাসাইল।  বাসাইল তো বংশী নদীরই আইল।

ভুয়াপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
কিংবদন্তী আছে, বারো ভুঁইয়াদের নাম থেকে ভুয়াপুর নামের উৎপত্তি।  মানিকগঞ্জ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বিভিন্ন যুদ্ধে মোঘলদের হাতে পরাজিত ভুঁইয়া সৈন্যবাহিনী ও অনুচরেরা পালিয়ে এসে নিরাপদ স্থানে ভুয়াপুর অঞ্চলে আস্তানা গড়ে তোলে। মোঘল দ্বন্ধ সংঘাতের পরিণতিতে পরাজিত সৈন্য, পাইক বরকন্দাজ ভুঁইয়াদের কোন প্রতিনিধি ও তাদের অনুচরবর্গ নিরুপদ্রব অঞ্চল হিসেবে যমুনা বিধৌত এই এলাকাতে কালক্রমে বসতি স্থাপন করে। সেই থেকেই এ এলাকার নাম হয়েছে ভুয়াপুর।  আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, একসময় বর্তমান এলাকায় এক সম্ভান্ত ও প্রভাবশালী ভুঁইয়া পরিবার বসবাস করতো।  এই ভুঁইয়া পরিবারের নাম থেকে এই এলাকার নাম হয় ভুয়াপুর।

দেলদুয়ার উপজেলার নামকরণ ইতিহাস :
ঐতিহ্যবাহী দেলদুয়ার উপজেলার সৃষ্টি হয় ১৯৮১ সালে। ১৯৮৩ সালে একে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।   ‘দিল’ অর্থ মন,  দুয়ার অর্থ দরজা।  দেলদুয়ার অর্থ মনের দরজা।  এই দেলদুয়ারই কিঞ্চিৎ বিকৃত হয়ে দেলদুয়ার হয়েছে।  আবার  এ উপজেলার  বয়োবৃদ্ধদের মুখে শোনা যায় বহুকাল আগে অর্থাৎ  দেলদুয়ার  যখন নিতান্তই জংগলাকীর্ণ  অজপাড়াগাঁ  ছিল  তখন  এ অঞ্চলে  অলৌকিক ও আধ্যাত্বিক ক্ষমতা ও জ্ঞানসম্পন্ন দিলদার নামে এক পাগলের বিচরণ ছিল।  সেই পাগলের নামে এ এলাকাকে সবাই  দিলদার  পাগলার  এলাকা বলে ডাকতো।  সেই দিলদার পাগলার এলাকাই কালের প্রেক্ষিতে নাম বদলে দেলদুয়ার হয়েছে।

ঘাটাইল উপজেলার নামকরণ ইতিহাস :
জানা যায়, অতীতে ঘাটাইল যমুনা তীরে গড়ে উঠেছিল। স্থাণীয় তথ্য থেকে জানা যায়, এখানে একটি ঘাট ছিল, যার সাহায্যে লোকজন ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরাজগঞ্জ থেকে আসা-যাওয়া করতো। কৃষি জমির উঁচু সীমানা আইল ঘাটে যাওয়া-আসার রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কালক্রমে এই ঘাট ও আইল শব্দ দুটির সমন্বয়ে এই জায়গার নাম হয় ঘাটাইল।

গোপালপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
স্থানীয় বিশ্বাস থেকে জানা যায়, অতীতে এই এলাকায় গোপাল শাহ্ নামে দরবেশ বাস করতেন। এই দরবেশের নামানুসারে গোপালপুর নামের উদ্ভব হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

মধুপুর উপজেলার  নামকরণ ইতিহাস :
ঐতিহ্যবাহী শালবন বিহারখ্যাত মধুপুর থানা সৃষ্টি হয় ১৮৯৮ ইং সালে। ১৯৮৩ ইং সাল হতে উপজেলায় উন্নীতকরা হয়।  মধু হতে নাম হয়েছে মধুপুর।

মির্জাপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
জানা যায়, মোঘল আমলে রাজস্ব কালেক্টর মির্জা হুসেন বর্তমান এলকা লীজ নেন। মনে করা হয় মির্জা হুসেনের নামানুসারে এই এলাকার নাম হয়েছে মির্জাপুর।

নাগরপুর উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
এ উপজেলার নামকরণ নিয়েও একাধিক লোক- কাহিনী বা জনশ্রুতি প্রচলিত।  জনশ্রুতি রয়েছে এই- সুলতান মাহমুদশাহ-র শাসন আমলে নাগরপুরের মামুদনগর ছিল তাঁর রাজধানী।  এখানে তাঁর  একটি  বিশাল এক নৌঘাটি ছিল।  শোনা যায় বিদেশী আক্রমনের হাত থেকে এই অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্যেই সম্রাট মাহমুদ  শাহ  এই নৌ  ঘাটিটি নির্মাণ করেছিলেণ। মামুদনগরে এখনো শেরশাহ-র জঙ্গল, মতিবিবিরি বাগ এবং ১০১টি পুকুরের অস্তিত্ব আঁচ করা যায়।  কথিত  আছে এক রাতেই পুকুরগুলো খনন করা হয়েছিল।  এক সময় বর্তমান চৌহালীর পূর্বাংশ-নাগরপুর  এবং  দৌলতপুরের  অংশ বিশেষে সহ পুরো এলাকা ছিল নদী এলাকা।  কালের বিবর্তনে এই এলাকা চর এলাকায় রূপ নেয।  চর অঞ্চল হলেও  জনপদ  সৃষ্টির  পূর্বে  এখানে প্রচুর বনজঙ্গল ছিল।  জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ থাকত।  সাপগুলো বিভিন্ন নাগ- নাগিনী নামে পরিচিত ছিল।  বিষাক্ত সাপের ভয়ে ভীত থাকত সবাই।  মানুষ একা চলতে সাহস করত না।  সব  সময়ই  দলবদ্ধভাবে  চলাচল করত।  এই সময় ভারতে পুরী থেকে ‘‘ নাগর মিয়া’’ নামে এক বৃদ্ধ এই এলাকায় আসেন।  শোনা যায় তিনি ছিলেন  অবিবাহিত।এবং  প্রকৃত প্রেমিক।  সাপ বা সরীসৃপ নিয়েই তিনি জীবন যাপন করতে ভালবাসেন। এই ভালভাসার  সূত্র ধরেই ভারতের পুরী থেকে একে একে  তার  অনেক অনুসারীরা আসতে থাকল এবং এক সময় এ অঞ্চল মানুষের জন্যে ভয় থেকে অভয়ের অঞ্চল হয়ে উঠল।  আর এভাবেই নাগরে -নাগরে পূর্ণ হয়ে এলাকার নাম হলো নাগরপুর।  অবশ্য এর ভিন্ন মতও দেখা যায়।

সখিপুর উপজেলার নামকরন ইতিহাস:
সখিপুর নামকরণ কবে কোথায় কিভাবে হয়েছে তা সঠিকভাবে নিরুপণ করা খুবই কঠিন। তবে আকুল মন্ডল নামক একজন রাজবংশী তার দলবল নিয়ে বর্তমানে সখিপুর উপজেলা পুকুর পাড়ে বসতি স্থাপন করেন। রাজবংশীদের মেয়েগুলো খুবই সুন্দরী ছিল।  আকুল মন্ডলের একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটির নাম ছিল সখী। এ অনিন্দ্য সুন্দরী ‘‘সখী’’  এর নাম অনুসারে এ এলাকার নামকরণ করা হয়  ‘‘সখিপুর’’।

কালিহাতী উপজেলার নামকরন ইতিহাস:
কালিহাতী উপজেলার কৃতি সন্তান বিদগ্ধ লোক সাহিত্যিক ডঃ আশরাফ সিদ্দিকীর লিখিত অভিমত অনুসারে কীল্লা-ই-হাতী—— এ শব্দটির অপভ্রংশ কালিহাতী। কালিহাতীসহ  পার্শ্ববর্তী  অঞ্চলসমূহ  পাঠান শাসন  আমলে থাকাকালে  ঝিনাই নদী প্রকাশ  ফটিকজানী নদীর তীরে অবস্থিত পুরাতন থানার স্থানে একটি সেনা ছাউনী বসানো হয়। সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য ছিল অশ্ব এবং হাতী। তাই হাতীর কীল্লা বা কীল্লা-ই-হাতী নামে এ সেনা ছাউনী পরিচিতি লাভ করে।  এ শব্দই কালক্রমে এ স্থানটির নামরূপে কালিহাতীতে পরিনত হয়।  অন্য একটি অভিমত কালিহাতী সদর বাসী প্রাক্তন বোদ্ধা ব্যক্তিগণের। তাঁরা বলেন কালিহাতী সদরে অবস্থিত বর্তমান বৃহৎ কালী মন্দিরটি পার্শ্ববর্তী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। সংলগ্ন বর্তমান সাপ্তাহিক বৃহৎ হামিদপুর হাটটি শতাধিক বর্ষপূর্বে কালীর হাট নামে পরিচিত ছিল। ঐ সূত্রে স্থানটির নাম লোকমুখে হয় কালিহাটী। অবশেষে কালিহাটী রূপান্তরিত হয় কালিহাতীতে।

 বরগুনা নামের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও জানা যায় যে, উত্তরাঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলে কাঠ নিতে এস খরস্রোতা খাকদোন নদী অতিক্রম করতে গিয়ে অনুকুল প্রবাহ বা বড় গোনের জন্য এখানে অপেক্ষা করত বলে এ স্থানের নাম হয় বড় গোনা।কারো মতে আবার স্রোতের বিপরীতে গুন (দড়ি) টেনে নৌকা অতিক্রম করতে হতো বলে এ স্থানের নাম বরগুনা। কেউ কেউ বলেন, বরগুনা নামক কোন প্রভাবশালী রাখাইন অধিবাসীর নামানুসারে বরগুনা।  আবার কারো মতে বরগুনা নামক কোন এক বাওয়ালীর নামানুসারে এ স্থানের নাম করণ করা হয় বরগুনা।

আমতলী উপজেলা নামকরণ ইতিহাস:
লোকশ্রুতি আছে সুদূর অতীতকালে পায়রা নদীর তীরে বহু আম গাছ ছিলমাঝিরা  তাদের নৌকা বাঁধত সেই আম গাছের সাথে নৌকা  বাঁধার স্থানটি কালে কালে হয়ে যায় আমতলা থেকে আমতলী। অন্যদিকে,  পায়রা নদীর একটি প্রবাহ আমতলী বন্দরের পূর্ব দিক দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে আমতলী নদী প্রবাহিত হয়েছিল।  নৌযান চলাচল মুখরিত আমতলী নদীর তীরে পাঠান আমলে গড়ে ওঠেছিল জনবসতি ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র।  মোগল যুগে পায়রা  নদীতে মগ, পর্তুগীজদের লুণ্ঠন ও অত্যাচার বেড়ে গেলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আমতলী নদীই ছিল একমাত্র ভরসা। এ নদীর নাম অনুসারে এলাকার নাম হতে পারে আমতলী।  আবার, অতীতে  আমতলী যখন অরণ্য আচ্ছাদিত  হয়ে  দুর্গম এলাকা হিসেবে ছিল তখন আরকান থেকে আগত জনৈক আমপাটি  নামক  মগ দলপতি ইংরেজি সরকার থেকে ইজরা নিয়ে আমতলী প্রথম আবাদ শুরু করে ছিলেন। সম্ভবতঃ  আমপারিট মগের নাম অনুসারেও এলাকায়  নাম আমতলী হতে পারে।

বামনা উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
বামনার নামকরণ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কারও মতে শফি মাহমুদ চৌধুরী কর্তৃক নির্মিত কালী মন্দিরের ব্রাহ্মণ পুরোহিত কীর্তি চরণ মুখপাধ্যায়কে স্থানীয় লোকজন ব্রাহ্মণ শব্দের অপভ্রংশ বামনা হিসেবে ডাকত। তার ডাক নামানুসারেই বামনা নামের উৎপত্তি হয়। কারও মতে তৎকালীন সুন্দর বন এলাকার আওতাভুক্ত বিষখালী নদী দিয়ে বাওয়ালীরা নৌকায় যাতায়াত করত । এক সময় বামন নামক কোন এক বাওয়ালী নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে নিখোঁজ হলে তার নামানুসারে বামনা নাম করণ হয়। কারও মতে একদল মৌলবাদী পর্যটক ধর্ম প্রচারের জন্য এখানে আসেন এবং ধর্ম প্রচার শুরু করেন। কিন্তু বেশীর ভাগ লোকই বামপন্থী মনা হওয়ায় তাদেরকে ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করতে পর্যটক দল ব্যর্থ হয়ে এলাকার মানুষকে বাম মনা উপাধি দেয়। এই বাম+মনা থেকেই বামনা শব্দের উদ্ভব হয়। আরও প্রসিদ্ধ প্রচলন রয়েছে যে, চীন দেশ থেকে চেং ইয়াং নামে এক নাবিক পাঁচটি সম্প্রদায়ের লোক এবং কিছু যন্ত্রপাতি ও পশু -পাখি নিয়ে জাহাজ চালিয়ে এখানে এসে বর্তমান চেঁচানে নামেন ।  চেঁচান নামটি প্রধান নাবিক চেং ইয়াং-এর নামানুসারে হয়েছে। এই পাঁচটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এক দল ছিলেন ব্যবসায়ী যারা বাণিজ্যের লক্ষ্যে এসেছিলেন, এক দল ছিলেন কৃষিজীবী যারা কৃষি কাজ করতেন, এক দল ছিলেন নাবিক যারা জাহাজ বা নৌকায় পারাপার ও পরিবহনের কাজ করতেন, এক দল ছিলেন রাখাল যারা পশু পালন ও চারন করতেন এবং এক দল ছিলেন ব্যায়ামবিদ যারা নিরাপত্তা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের দায়িত্ব পালন করতেন।  ইংরেজীতে এ পাঁচ সম্প্রদায়ের নাম হল ব্যবসায়ী = Businessman যা থেকে B, কৃষিজীবী= Agriculturist যা থেকে A, নাবিক = Mariner যা থেকে M, রাখাল= Nomad যা থেকে N এবং ব্যায়ামবিদ= Acrobat যা থেকে A । এই সম্প্রদায়গুলোর নামের পাঁচটি আদ্যাক্ষর দিয়ে B+A+M+N+A= BAMNA যা বাংলায় বামনা নামকরণ করা হয়।

পাথরঘাট উপজেলার নামকরণ ইতিহাস :
পাথরঘাটা নামকরণের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি রয়েছে যে, এ উপজেলার ভূ-অভ্যন্তরে বিদ্যমান পাথরের অস্তিত্ব থেকেই পাথরঘাটা নামকরণের সূচনা হয়েছিল। ১৯০৩ সনে এ নামকরণ সূত্রপাতঘটে মর্মে ধারণা করা হয়। তৎকালীন বৃটিশ আমলে চট্রগ্রাম মাইজ ভান্ডার শরীফ থেকে বাগেরহাটের খাজা খান জাহান আলী নদীপথে অলৌকিকভাবে বাগেরহাটে পাথর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় বিশখালী এবং বলেশ্বর নদীর মোহনায় এক রাতের জন্য ঘাটি স্থাপন করেছিলেন। উক্ত পাথরের কিয়দংশ এখানে রয়ে যায়। সে কারণেই এলাকাটি পাথরঘাটি নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে পাথরঘাটি নামটি পাথরঘাটা নামে নবরূপ লাভ করে।

আরো জানুন:  বাংলাদেশের ৬৪ জেলা উপজেলা সহ বিভিন্ন স্থানের নামের ইতিহাস

বেতাগী উপজেলার নামকরণ ইতিহাস:
বেতাগী শব্দের নামকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশের মতে বেদাগী থেকে বেতাগী নামের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। অষ্টাদশ প্রথম দিকে ইংরেজ শাসকরা শত শত নিরীহ লোক ধরে এনে দক্ষিণ জনপদে লবন চাষ করাতে কৃষকদের উপর নানারকম জোর জবরদস্তি ও নির্যাতন চালাতো। এমনকি তাদেরকে তামাক সেবনেও অভ্যস্ত করতো বলে জানা যায়। এসময় তৎকালীন শাসনামলে বুজুর্গ উমেদপুরের প্রতাপশালী জমিদার ও কৃষক নেতা আইন উদ্দীন সিকদার এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন ও গড়ে তোলেন ও কৃষকদের সংগঠিত করে লবন চাষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এতে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অনেক ইংরেজও মারা যায়। ইংরেজরা আইন উদ্দিন সিকদারের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে ও তাকে কুখ্যাত ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৭৮৯ সালে তার জমিদারী কেড়ে নেয়া হয় এবং তাকে গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সে সময়ের ধর্মীয় নেতা নেয়ামত শাহের নিকট এলাকার জনসাধারন আইন উদ্দিন সিকদারের মুক্তির জন্য সাহায্য চাইলে তিনি তৎকালীন ঢাকাস্থ মোগল সুবেদার ইসলাম খার নিকট আইন উদ্দিন সিকদারের পক্ষে সুপারিশ করে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এ চিঠিতে তাকে দাগী নয়, বেদাগী (অপরাধী নয়) বলে আখ্যায়িত করে। ফরাসী শব্দ বেদাগী থেকেই কালক্রমে বেতাগী শব্দের রুপান্তরিত হয়ে বেতাগীর উদ্ভব হয় বলে ধারনা করা হয়।
এছাড়া বেতাগী অঞ্চলে আগে অনেক বেত পাওয়া যেত এবং বেতের আগা একটি জনপ্রিয় সবজি হিসাবে সকলের কাছে বেশ কদর ছিল। সেই “বেতাগা” এর সূত্র ধরে বেতাগীর উৎপত্তি হতে পারে। বেতাগীর নামকরণে আবার কেউ কেউ মনে করেন, ইংরেজদের কাউকে কোন কাজে বাধ্য না করাতে পারলে চরম বেত্রাঘাত করত। এখানের মানুষ প্রতিবাদী হওয়ার কারনে আরও বেশি বেত্রাঘাতের স্বীকার হত। এই বেত্রাঘাত শব্দানুসারে বেতাগী নামের সৃষ্টি হয়েছে।

তথ্যসুত্রঃ জেলা তথ্য বাতায়ন, উইকিপিডিয়া।

About Sabuj Vumi Editor

Check Also

ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ ইতিহাস

ঝিনাইদহ জেলার নামকরণ ইতিহাস: জনশ্রুতি আছে প্রাচীনকালে বর্তমান ঝিনাইদহের উত্তর পশ্চিম দিকে নবগঙ্গাঁ নদীর ধারে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Flag Counter